আজ সোমবার | ১২ মে ২০২৫ | ২৯ বৈশাখ ১৪৩২ | ১৩ জিলকদ ১৪৪৬ | রাত ৯:৪৮

সংস্কার আর দুর্নীতি কি একসঙ্গে চলতে পারে

ডান্ডিবার্তা | ২৬ এপ্রিল, ২০২৫ | ১০:০৮ পূর্বাহ্ণ

মনজুরুল ইসলাম
২০২৪ সালে জুলাই–আগস্টের অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন ছাত্রছাত্রীরা। তাঁদের মধ্যে যাঁরা নেতৃস্থানীয় ছিলেন, মূলত তাঁদের উদ্যোগ ও পছন্দ অনুসারেই অন্তর্র্বতী সরকার গঠিত হয়েছিল। ছাত্রনেতাদের মধ্য থেকে দুজন অন্তর্বতী সরকারের উপদেষ্টা হিসেবেও দায়িত্ব নেন। এ ছাড়া বেশ কিছু মন্ত্রণালয়ে বিভিন্ন পদে ছাত্রদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্রদের আরেকটা অংশ রাজনৈতিক দল গঠনের তৎপরতায় যুক্ত হয়েছিল; ছাত্র–তরুণেরা প্রাথমিকভাবে সংগঠিত হন ‘জাতীয় নাগরিক কমিটি’র ব্যানারে। এরপর ফেব্রæয়ারির শেষে বেশ ‘জাঁকজমকপূর্ণ’ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) নামে একটি নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করা হয়। ছাত্র-তরুণদের উদ্যোগে প্রথমে সরকার এবং পরে রাজনৈতিক দল গঠন—এ দুটি ঘটনা অনেকের মধ্যেই আগ্রহ তৈরি করেছিল। রাষ্ট্র পরিচালনা ও রাজনীতিতে তাঁরা ইতিবাচক কিছু করবেন—এমন প্রত্যাশাও করা হয়েছিল। তবে সরকারি পদ এবং দলের দায়িত্বে থাকা কোনো কোনো তরুণের কর্মকাÐে সেই প্রত্যাশার পারদ দিন দিন কমছে; কারও কারও বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগও উঠেছে। অন্তর্র্বতী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদে যেমন ছাত্র প্রতিনিধিরা আছেন, তেমনি বেশ কিছু মন্ত্রণালয়ে বিভিন্ন পদে ছাত্রদের বা তাঁদের পছন্দের ব্যক্তিদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। এ রকম দুজন ছিলেন স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় এবং যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়ার সহকারী একান্ত সচিব (এপিএস) মোয়াজ্জেম হোসেন এবং স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নূরজাহান বেগমের ব্যক্তিগত কর্মকর্তা মুহাম্মদ তুহিন ফারাবী। স¤প্রতি এ দুই কর্মকর্তাকে তাঁদের পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। (সরিয়ে দেওয়া হলো দুই উপদেষ্টার দুই ব্যক্তিগত কর্মকর্তাকে।
মোয়াজ্জেম হোসেনের বিরুদ্ধে তদবির-বাণিজ্যের অভিযোগ উঠেছে। মোয়াজ্জেম হোসেন বিভিন্ন পর্যায়ে নিয়োগ ও বদলি-বাণিজ্য, টেন্ডার-বাণিজ্য ও ফ্যাসিবাদের দোসর প্রকৌশলীদের পুনর্বাসনের মাধ্যমে শতকোটি টাকা হাতিয়েছেন। প্রায় একই অভিযোগ উঠেছে স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নূরজাহান বেগমের ব্যক্তিগত কর্মকর্তা তুহিন ফারাবী ও মো. মাহমুদের বিরুদ্ধে। ছাত্রনেতা থেকে ‘সরকারি কর্মকর্তা’ বনে যাওয়া যেসব ব্যক্তির বিরুদ্ধে শতকোটি টাকার দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে, পদ থেকে তাঁদের সরিয়ে দেওয়াই কি যথেষ্ট? তাঁদের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগগুলো নিয়ে কি তদন্ত করা হবে না? এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট উপদেষ্টাদের ভূমিকা কি স্পষ্ট হওয়া উচিত নয়? ‘রেলকে একটি লাভজনক ও জনকল্যাণকর প্রতিষ্ঠানে পরিণত’ করার কাজে সহযোগিতা করতে ‘দায়িত্ব’ দেওয়া হয়েছিল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের তিন সক্রিয় কর্মীকে। এই ছাত্ররা ট্রেনের টিকেট কালোবাজারি সঙ্গে জড়িত বলে অভিযোগ করেছেন রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সাবেক অতিরিক্ত সচিব মাহবুব কবির মিলন।
মাহবুব কবির মিলন তাঁর ফেসবুক পোস্টে ওই তিন ছাত্রের বিরুদ্ধে বদলি–বাণিজ্য ও অন্যান্য সুযোগ–সুবিধা নেওয়ারও অভিযোগ করেন। ছাত্রদের সম্পর্কে তিনি লিখেছেন, ‘রেল ভবনে এদের অবাধ বিচরণ। অবাধ বাণিজ্য। সারা দেশের কর্মচারী–কর্মকর্তাদের কাছে ত্রাস এরা তিনজন। মন্ত্রণালয়ের অনেক কর্মকর্তা এদের দেখলে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে সমীহ করে।…’
রেলপথ মন্ত্রণালয়ের মতো একটি কারিগরি ও বিশেষায়িত মন্ত্রণালয়ে ছাত্রদের ‘দায়িত্ব’ দেওয়ার বিষয়টি প্রথম থেকেই প্রশ্নবিদ্ধ ছিল। এবার তাঁদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ উঠল। যে অভিযোগগুলো উঠেছে, সেগুলোর ব্যাপারে কি কোনো তদন্ত হবে? শুধু সরকারি পদে বা দায়িত্বে থাকা ছাত্র প্রতিনিধিদের বিরুদ্ধেই নয়, দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে নবগঠিত রাজনৈতিক দল এনসিপির কোনো কোনো নেতার বিরুদ্ধেও। অন্তর্র্বতী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পরে জেলা প্রশাসক (ডিসি) নিয়োগে অবৈধভাবে হস্তক্ষেপ এবং জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) পাঠ্যবই ছাপার কাগজে কমিশন–বাণিজ্যের অভিযোগ ছিল বহুল আলোচিত বিষয়। এ দুই অভিযোগে জাতীয় নাগরিক পার্টির যুগ্ম সদস্য সচিব গাজী সালাউদ্দিন তানভীরকে দলের সব দায়িত্ব ও কার্যক্রম থেকে সাময়িক অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। দল থেকে কাউকে অব্যাহতি দেওয়া বা বহিষ্কার করা হলো সাংগঠনিক ব্যবস্থা। কিন্তু গাজী সালাউদ্দিন তানভীরের বিরুদ্ধে যে অভিযোগগুলো উঠেছে, সেগুলো প্রতিটি ফৌজদারি অপরাধ। তাহলে তাঁর বিরুদ্ধে এখনো কেন আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না?
সংস্কার যতটুকুই হোক আর যেভাবেই হোক, জনগণের দিক থেকে ন্যূনতম আকাঙ্ক্ষা বা প্রত্যাশা হলো রাষ্ট্রকে হতে হবে জবাবদিহিমূলক ও যথাসম্ভব দুর্নীতিমুক্ত। এ ক্ষেত্রে অন্তর্র্বতী সরকার এবং ‘সংস্কারপন্থী’ দল এনসিপি নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে অনেকেরই এমন প্রত্যাশা ছিল। কিন্তু তারা সেই দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারছে, নাকি পুরোনো পথেই হাঁটছে, তা নিয়ে এরই মধ্যে জনমনে প্রশ্ন তৈরি হয়েছে। অন্তর্বতী সরকারের উপদেষ্টাদের নিয়ে নানা রকম ‘কানাঘুষা’ শোনা গেলেও এখন পর্যন্ত তাঁদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির সুনির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ উঠেনি। তাঁরা ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সে রকম কোনো অভিযোগ ওঠার সুযোগ রয়েছে কি না, তা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। এর একটি অন্যতম কারণ হলো দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) ভূমিকা। ‘অন্তর্র্বতী সরকার দুর্নীতিমুক্ত’ বলে এরই মধ্যে সরকারকে একরকম ‘দায়মুক্তি’ দিয়েছেন দুদকের চেয়ারম্যান আব্দুল মোমেন। দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য দুদক হলো একটি বিশেষায়িত সংস্থা। সেই সংস্থার প্রধান কি এভাবে কোনো সরকারকে ‘দুর্নীতিমুক্ত’ বলে দিতে পারেন? সরকার– সংশ্লিষ্ট কারও বিরুদ্ধে পরবর্তী সময়ে যদি দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে, তখন তিনি কী বলবেন?
বাংলাদেশে মন্ত্রী, এমপি, সচিবসহ সরকারি কর্মকর্তা এবং ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের নেতা–কর্মীদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ নতুন কিছু নয়। প্রায় সব সরকারের আমলেই কমবেশি এমন অভিযোগ উঠেছে। ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনার দেড় দশকের স্বৈরাচারী শাসনামলের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্যও এই দুর্নীতি।
শেখ হাসিনার আমলে রাজনীতিক, ব্যবসায়ী এবং আমলাতন্ত্র অর্থাৎ সরকারি কর্মকর্তাদের নিয়ে শক্তিশালী সিন্ডিকেট বা চক্র তৈরি হয়েছিল। তারা দুর্নীতির নতুন নতুন খাত ও পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছিল এবং দুর্নীতির পরিমাণ ও মাত্রার দিক থেকে আগের সব আমলকে ছাড়িয়ে গিয়েছিল। যেসব কারণে বিগত সরকারের প্রতি দেশের মানুষের তীব্র অনাস্থা, ক্ষোভ ও বিরোধিতা তৈরি হয়েছিল, তার মধ্যে সরকার–সংশ্লিষ্ট লোকজনের দুর্নীতিও অন্যতম কারণ। হাসিনা-পরবর্তী বাংলাদেশে অনেকই ‘নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত’ নিয়ে কথা বলছেন, রাষ্ট্র ও রাজনীতিতে নানা ধরনের ‘সংস্কার’ চাইছেন। এই সংস্কারের ব্যাখ্যা বা বোঝাপড়া একেকজনের কাছে একেক রকম। রাজনৈতিক দল, সংগঠন, এমনকি ব্যক্তিভেদেও সংস্কার নিয়ে আলাদা আলাদা চিন্তাভাবনা ও আকাঙ্খা রয়েছে।
সংস্কার যতটুকুই হোক আর যেভাবেই হোক, জনগণের দিক থেকে ন্যূনতম আকাঙ্খা বা প্রত্যাশা হলো রাষ্ট্রকে হতে হবে জবাবদিহিমূলক ও যথাসম্ভব দুর্নীতিমুক্ত। এ ক্ষেত্রে অন্তর্বতী সরকার এবং ‘সংস্কারপন্থী’ দল এনসিপি নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে অনেকেরই এমন প্রত্যাশা ছিল। কিন্তু তারা সেই দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারছে, নাকি পুরোনো পথেই হাঁটছে, তা নিয়ে এরই মধ্যে জনমনে প্রশ্ন তৈরি হয়েছে। একটা সহজ বিষয় আমাদের সবাইকে মনে রাখতে হবে, দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে না পারলে কোনো সংস্কারই শেষ পর্যন্ত টেকসই হবে না বা কাজে আসবে না।
মনজুরুল ইসলাম প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক




Your email address will not be published.

Comments are closed.


আজকের পত্রিকা
আজকের পত্রিকা
ফেসবুকে আমরা
পুরনো সংখ্যা
সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি রবি
 
১০১১
১২১৩১৪১৫১৬১৭১৮
১৯২০২১২২২৩২৪২৫
২৬২৭২৮২৯৩০৩১  
Copyright © Dundeebarta 2024
ডান্ডিবার্তা