আজ শনিবার | ৩১ মে ২০২৫ | ১৭ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২ | ৩ জিলহজ ১৪৪৬ | দুপুর ২:৫৪

আসলে ব্যর্থতার দায় কার সরকারের নাকি দেশের

ডান্ডিবার্তা | ২৬ মে, ২০২৫ | ১২:৪৬ অপরাহ্ণ

জিয়াউদ্দিন চৌধুরী
একটি বাংলা গানের প্রথম কলি এ রকম, ‘আমার বয়স বাড়ে কিন্তু আমি বাড়ি না’। এককথায়, আমার বয়স হলেও আমি অপরিণত থেকে যাই। বিখ্যাত স্কটিশ লেখক উইলিয়াম ব্যারি তাঁর উপন্যাসে ‘পিটার প্যান’ নামের একটি চরিত্র সৃষ্টি করেছিলেন। সেই চরিত্র সব সময় শিশুর মতো ব্যবহার করত। তার আশপাশের সবাই পরিপক্ব হলেও সে চিরকাল বালখিল্য ব্যবহার করে মানুষকে আমোদ দিত। ‘পিটার প্যান’ চরিত্রটি পরে ইংরেজি ভাষায় ব্যবহার করা হয় এমন একজন ব্যক্তির বর্ণনা দিতে, যিনি পরিপক্বতাতেও বড় হতে চায় না। মানুষটি চিরকাল অপরিপক্ব থেকে যায়, যে দুই বছরের শিশুর মতো আচরণ করে। এই মানুষগুলো কখনোই শৈশবের অহংকেন্দ্রিক, আত্মকেন্দ্রিক, অপরিণত পর্যায় অতিক্রম করতে পারে না। আমি এই উপসর্গকে একটি দেশ বা জাতিকে বর্ণনা করার জন্য প্রসারিত করতে পারি, যদি এটি বর্ণনার সঙ্গে খাপ খায়। আমি আমার প্রিয় দেশ বাংলাদেশের জন্য এই উপমা টানতে বাধ্য হচ্ছি। সমাজের অবস্থা দেখে মনে হয় না কোনো দায়িত্বশীল ব্যক্তি দেশে আছে। যে যার খুশিমতো আন্দোলন চালাচ্ছে। তার দাবি নিয়ে হয় অফিস ঘেরাও করছে কিংবা রাস্তা অবরোধ করছে, তার অধিকর্তা কিংবা প্রতিষ্ঠানপ্রধানের অপসারণ চাইছে। তাদের কাছে নিজের চাওয়া সবচেয়ে জরুরি, যা এখনই সমাধান করতে হবে। তা না হলে সে ঘেরাও ছাড়বে না, রাস্তায় কাউকে চলতে দেবে না, দরকার হলে আমৃত্যু অনশন করতেও রাজি। মানুষের আচরণ থেকে বোঝা যায় না যে এটি এমন একটি দেশ, যার বয়স ৫৫ পার হতে চলেছে আর দেশের জনগোষ্ঠীর প্রায় অর্ধেক মধ্যবয়স পেরিয়ে গেছে। কিন্তু মানুষের আচরণ সেই ‘পিটার প্যান’ চরিত্রের মতো, তারা এত বছরেও বদলাতে পারেনি। প্রতিটি দাবির জন্য তারা তাৎক্ষণিক সন্তুষ্টি চায়। এ দাবির ব্যাপারে কেউ কম যায় না। ছাত্র, সরকারি কর্মচারী, পুলিশ, ব্যবসায়ী, পরিবহনশ্রমিক এবং তারপর রাজনীতিবিদেরা যে দাবিগুলো উত্থাপন করেছেন, তার উদাহরণ নিন। দেশ একটি বিশাল আন্দোলনের ময়দানে পরিণত হয়েছে, যেখানে প্রায় প্রতিটি গোষ্ঠী নিয়ত বিক্ষোভ জানাচ্ছে আর তাদের নালিশের তাৎক্ষণিক সমাধান চাইছে। তারা তাদের দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত নতিস্বীকার করবে না। এটা হয়তো থামত, কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে অনেক ক্ষেত্রে তারা জয়ী হয়েছে এবং তারপর অন্যান্য অসন্তুষ্ট অংশের কাছ থেকে নতুন দাবি উত্থাপিত হচ্ছে। এ এক অন্তহীন চক্র। কিন্তু কীভাবে এবং কখন এটি শুরু হয়েছিল? ৯ মাস আগে ছাত্রদের দ্বারা শুরু হওয়া ব্যাপক বিক্ষোভ আমাদের ইতিহাসের এক অন্যতম রাজনৈতিক আন্দোলনে রূপান্তরিত হয়েছিল, যার ফলে একটি অত্যন্ত অজনপ্রিয় সরকার এবং এর সমানভাবে অজনপ্রিয় নেতাকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়েছিল। কিন্তু ৯ মাস আগের অস্থিরতা এখনো শেষ হয়নি। দুর্নীতিগ্রস্ত ও অত্যাচারী শাসনের পতনে যে গণস্বস্তি ও আনন্দ উদ্‌যাপন করা হয়েছিল, তা হয়ে গেল ক্ষণস্থায়ী। দীর্ঘদিন ধরে দুর্ভোগে থাকা জনগণের আশা ছিল, দেশ এক নতুন পথে যাবে। এর পাশাপাশি আরও একটি আশা ছিল, স্বৈরাচারী শাসনের শিকার জনগণ দেশে ন্যায়বিচার, সুশাসন এবং একে অপরের প্রতি শ্রদ্ধা ফিরিয়ে আনার যতœ নেবে। এটা ঠিক যে আগস্টের সরকার পরিবর্তন কোনো নির্বাচনের মাধ্যমে ছিল না, বরং এটা ছিল একটা গণ-আন্দোলনের পরিবর্তন। যেহেতু এ ধরনের আন্দোলনের নেতৃত্ব প্রথমে বিক্ষিপ্ত থাকে, তাই আইনশৃঙ্খলা স্থাপনে সরকারকে বেগ পেতে হয়। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর জরুরি কাজ প্রথম দিকে বিঘিœত হয়। কিন্তু যখন একটি সরকার নিয়মমাফিক গঠিত হয় ও অন্তর্বতীকালীন দায়িত্ব নেয়, তখন দেশ আশা করে যে এই নতুন সরকার জনসাধারণের মৌলিক চাহিদা মেটাতে তৎপর হবে যত দিন তারা এ দায়িত্বে আছে। এই মৌলিক চাহিদার মধ্যে অন্যতম দেশে আইনশৃঙ্খলা স্থাপন, মানুষের মৌলিক অধিকার, অর্থাৎ জানমালের নিরাপত্তা, স্বাধীনভাবে চলাফেরা এবং নিজের অধিকারের সঙ্গে অন্যের অধিকারের প্রতি সম্মান দেখানোর নিশ্চিত করা। কিন্তু কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে নেতৃত্বের পরিবর্তন হলেও এই মৌলিক অধিকারগুলো সর্বস্তরে ছড়িয়ে পড়েনি। আমরা বুঝতে পারি, বছরের পর বছর ধরে চাপা পড়ে থাকা অভিযোগগুলো ভুক্তভোগী গোষ্ঠী থেকে হঠাৎ বিস্ফোরণের কারণ হতে পারে এবং আমরা জুলাই আন্দোলনের পরে প্রথম কয়েক সপ্তাহে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর মধ্যে নিষ্ক্রিয়তা দেখেছি। এই জড়তা এমন একটি আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কাছ থেকে এসেছিল, যা এত দিন একটি দুর্নীতিগ্রস্ত নেতৃত্বের অধীন কাজ করে আসছিল। তবে আমরা আশা করেছিলাম, অন্তর্র্বতী সরকার স্থিতিশীল হলে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসবে। দুর্ভাগ্যবশত আগের সরকার চলে যাওয়ার প্রায় ৯ মাস পরও সেই স্থিতিশীলতার মুহূর্ত দেখা যাচ্ছে না। এই অস্থিতিশীলতায় অবদান রাখছে এমন ঘটনা বা যেসব গোষ্ঠী, যাদের ওপর সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ আছে বলে মনে হয় না। শিক্ষার্থীরা তাদের প্রতিষ্ঠানপ্রধানদের অপসারণের জন্য চিৎকার করে এবং দাবি পূরণের জন্য সামান্যতম অজুহাতে তাদের রাস্তায় নেমে যায়। চাকরিচ্যুত কর্মচারীরা চাকরি ফিরে পেতে চান বা রাস্তা অবরোধ করে তাঁদের ওপরওয়ালাকে অফিস থেকে সরিয়ে দিতে চান। অতি স¤প্রতি তরুণদের দ্বারা গঠিত একটি রাজনৈতিক দল তাদের দাবির তাৎক্ষণিক সমাধানের দাবিতে রাস্তা অবরোধ করে।
সব প্রতিবাদ রাস্তা অবরোধ ও অফিসের কার্যক্রম বন্ধের মাধ্যমে প্রদর্শন করার জন্য নয়। মানুষের অভিযোগ প্রকাশের অধিকার আছে, কিন্তু তা অন্যের চলাফেরার অধিকারে বাধা সৃষ্টি করার লাইসেন্স দেয় না। দুর্ভাগ্যবশত দেশের বর্তমান বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি ইঙ্গিত দেয় না যে এগুলো শিগগিরই শেষ হতে চলেছে। কারণ, এখন পর্যন্ত সব মহলে বিরাজ করা বিভ্রান্তি নিরসনে সমন্বিত প্রচেষ্টার কোনো নজির আমরা দেখিনি। আমরা জানি, সচেতন জনগণের মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করতে চায় না সরকার। কিন্তু সেই স্বাধীনতা দেশকে নৈরাজ্যে পরিণত করুক, এটা কেউ চায় না। এ স্বাধীনতা ক্রমেই মানবাধিকারের প্রথম নীতি, যা অন্যের অধিকারের আনুগত্য এবং সম্মান করাকে লঙ্ঘন করছে। আমাদের যুবকেরা একটি ঐতিহাসিক আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু ভূমিকায় ছিল। কিন্তু দেশকে আইনের শাসন দিতে ব্যর্থ একটি সরকারকে অপসারণের তাদের আন্দোলনের সাফল্য অচিরেই বাষ্পীভূত হয়ে যাবে, যদি বর্তমান অচলাবস্থা শিগগিরই শক্ত হাতে শেষ করা না যায়। বিক্ষোভ ও সমাবেশ শুরু হওয়ার আগে যাঁরা সেই সংস্থাগুলো পরিচালনা করছেন, তাঁরা থামাতে পারতেন বা পারেন, যদি তাঁরা এ সংস্থাগুলোর সমস্যা আগে থেকে চিহ্নিত করতে পারেন এবং তা সুরাহার জন্য প্রথমে নিজেরা এবং না পারলে তাঁর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের কাছে যান। সরকারের উচিত এসব সমস্যা সমাধানের জন্য প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনাকে দায়িত্ব দেওয়া। তাদের রাস্তায় নামার দরকার নেই। যদি তারা সমস্যাগুলো সমাধান করতে না পারে, তবে সে ব্যবস্থাপনা পরিবর্তন করা দরকার। এসব প্রতিষ্ঠানে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা দরকার। রাস্তাঘাট নিরাপদ করা দরকার, এগুলো সমাবেশের জায়গা নয়। পরিশেষে প্রত্যেক আইন লঙ্ঘনকারীর বিরুদ্ধে আইন প্রয়োগ করা দরকার। সরকারি–বেসরকারি যে–ই হোক। শুধু আইন প্রয়োগ করে হয়তো আমরা একশ্রেণির মানুষের বালখিল্য ব্যবহার বন্ধ করতে পারব না। তবে দেশের মানুষের সার্বিকভাবে মানসিক পরিপক্বতার জন্য আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যেও সামগ্রিকভাবে মানসিক পরিবর্তন দরকার। তাদেরও পরিপক্বতার প্রয়োজন। চাইলেই আজ ক্ষমতা হাতে আসবে, সেটা ঠিক নয়। জনগণ সেটা দেবে, যখন আপনাদের তারা উপযুক্ত মনে করবে। আশা করছি, আমাদের শিশুসুলভতা দূর হবে সবার ইচ্ছা থাকলে।
জিয়াউদ্দিন চৌধুরী সিভিল সার্ভিসের সাবেক কর্মকর্তা

 




Your email address will not be published.

Comments are closed.


আজকের পত্রিকা
আজকের পত্রিকা
ফেসবুকে আমরা
পুরনো সংখ্যা
সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি রবি
 
১০১১
১২১৩১৪১৫১৬১৭১৮
১৯২০২১২২২৩২৪২৫
২৬২৭২৮২৯৩০৩১  
Copyright © Dundeebarta 2024
ডান্ডিবার্তা