আজ মঙ্গলবার | ১৭ জুন ২০২৫ | ৩ আষাঢ় ১৪৩২ | ২০ জিলহজ ১৪৪৬ | সকাল ৯:৩৯

ইউনূস-তারেক সফল বৈঠকে স্বপ্নভঙ্গ হলো যাদের

ডান্ডিবার্তা | ১৬ জুন, ২০২৫ | ১২:২৮ অপরাহ্ণ

মারুফ মল্লিক
প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের ১ ঘণ্টা ২০ মিনিটের বৈঠক দেশের রাজনীতির মোড় অনেকটাই ঘুরিয়ে দিয়েছে। নানা অনিশ্চয়তা, শঙ্কা, গুজব রাজনীতিকে ঘিরে ধরেছিল। একধরনের অনাস্থার পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল। এ বৈঠক অনিশ্চয়তা, শঙ্কার কালো মেঘ সরিয়ে দিয়ে রাজনীতিতে আস্থার পরিবেশ সৃষ্টি করবে বলে আশা করা যায়। পারস্পরিক যে কাদা ছোড়াছুড়ি, দুর্নাম করার রাজনীতি, সেখান থেকে বেরিয়ে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের পথ তৈরিতে সহায়তা করবে অধ্যাপক ইউনূস ও তারেক রহমানের বৈঠক। নির্বাচন নিয়ে সরকারের সঙ্গে বিএনপির কিছুদিন ধরে টানাপোড়েন চললেও বৈঠকটি অত্যন্ত সৌহার্দ্যপূর্ণ ও আন্তরিক পরিবেশে হয়েছে। এটা আমাদের রাজনীতিতে উদাহরণ হয়ে থাকবে। বৈঠকটি সারা দেশের মানুষের মধ্যে নতুন করে আশার সঞ্চার করেছে। এখন মানুষ বিশ্বাস করতে শুরু করেছে যে ফেব্রæয়ারিতে নির্বাচন হবে। মানুষের ধারণাকে বাস্তবে রূপদান করার দায়িত্ব সরকারের। বিএনপি এর আগে ডিসেম্বরে নির্বাচন চাইলেও কিছুটা সরে এসে ফেব্রæয়ারির সময়সীমাকে মেনে নিয়েছে। সরকারও এপ্রিল থেকে সরে এসে নির্বাচন ফেব্রæয়ারিতে হতে পারে বলে মন্তব্য করেছে। উভয় পক্ষেরই কিছুটা সরে আসা, কিছুটা ছাড় দেওয়া এটাই আমাদের রাজনীতি থেকে একদম হারিয়ে গিয়েছিল। রাজনীতি মানেই প্রতিপক্ষের সঙ্গে শত্রæতা করতে হবে, এমন পরিস্থিতিতে আমাদের রাজনীতি পৌঁছে গিয়েছিল। কিন্তু শুধু কথায় কথায় উদার হলে হবে না। কাজে-কর্মেও উদারতা দেখাতে হবে। লন্ডনের বৈঠকে সেই উদারতার কিছু নমুনা আমরা দেখতে পেলাম। বৈঠক শেষে ব্রিফিংয়ে আলোচনার ফলাফল তুলে ধরা হয়েছে। তা নিয়ে আপাতত আলোচনার কিছু নেই। আমরা বরং রাজনীতিতে এ বৈঠকের প্রভাব নিয়ে আলোচনা করার চেষ্টা করি। প্রথমত, এ বৈঠক সারা দেশের মানুষকে আশান্বিত করলেও রাজনীতির কোনো কোনো পক্ষ বা ব্যক্তি হতাশ হয়েছেন। এসব গোষ্ঠীর মূল কাজ যেন বিএনপিকে যে কোনোভাবে ঠেকানো। ব্যক্তি পর্যায়ে যারা হতাশ হয়েছেন তাদের মধ্যে রাজনীতিবিদ ও অরাজনৈতিক ব্যক্তিরা আছেন। তাঁদের মূল লক্ষ্যই ছিল, যেকোনো প্রকারে বিএনপির রাজনীতিকে প্রতিহত করা। এ অংশ চাইছে না বিএনপির রাজনীতি সামনের দিকে এগিয়ে যাক। বিএনপির নেতৃত্বে নতুন করে বাংলাদেশের বিনির্মাণ হোক। কেউ যদি সহজ রাজনীতির পথ পরিহার করে অহেতুক কুটিল ও ষড়যন্ত্রের রাজনীতি করে, তবে তারা নিজেরাই রাজনীতি থেকে হারিয়ে যায়। আওয়ামী লীগ ও জাসদ আমাদের সামনে রাজনীতি থেকে হারিয়ে যাওয়ার সবচেয়ে বড় উদাহরণ। বিএনপি যে শত ভাগ শুদ্ধ ও সঠিক রাজনীতি করছে, এটা বলা যাবে না। ভুল-ত্রæটি বিএনপিরও আছে। স্থানীয় পর্যায়ে বিএনপির নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি, দখল, হত্যাসহ নানা অভিযোগ রয়েছে। বিএনপি নিজ দলের নেতা-কর্মীদের নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে। এই পর্যন্ত চার হাজারের মতো নেতা-কর্মীকে দল থেকে বহিষ্কার করেছে এসব কর্মকাÐের জন্য। দেশের ইতিহাসে কোনো দল নিজেদের এতসংখ্যক নেতা-কর্মীকে বহিষ্কার করেনি। এ ধরনের অপরাধ শুধু বিএনপির নেতা-কর্মীরাই করছেন না। বিভিন্ন দলের নেতা-কর্মীরাও এর সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছেন। দুঃখজনক হলেও সত্যি যে এটা আমাদের রাজনৈতিক অপসংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে। এখান থেকে বেরিয়ে আসতে হলে আমাদের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা লাগবে। রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তন করতে হবে। এটা সময়সাপেক্ষ বিষয়। বাস্তবতা হচ্ছে আমাদের রাজনীতি এই অর্থনীতির ওপর দাঁড়িয়ে আছে। তাই রাজনৈতিক সরকার লাগবে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে। কারণ, অন্তর্বতীকালীন সরকার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। এ ধরনের পরিস্থিতি শুধু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দিয়েই নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। এর সঙ্গে রাজনৈতিক শক্তিরও প্রয়োজন হয়। বিকল্প অর্থনৈতিক কর্মসূচিও লাগে। এ জন্যই বিএনপি বারবার নির্বাচনের কথা বলে আসছে। আমরা মনে করি, নির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় এলে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিসহ সার্বিক অবস্থান উন্নতি ঘটবে। বিএনপির বিকল্প অর্থনৈতিক পরিকল্পনা আছে। কিন্তু একটি সুবিধাবাদী ও স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী কোনোভাবেই চায় না যে সহসাই একটি নির্বাচন হোক। তাদের লক্ষ্য, যেভাবেই হোক নির্বাচন বিলম্বিত করে পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটানো। তাহলে ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করা সহজ হতো গোষ্ঠীটির জন্য। তাদের ভাবনা যেন এমন এই মাছ শিকারের জন্য কোনোভাবেই বিএনপিকে রাজনীতির মাঠে দাঁড়াতে দেওয়া যাবে না। অনলাইন, অফলাইন দুই জায়গাতেই সমানভাবে এই গোষ্ঠী সক্রিয় হয়ে রীতিমতো বিএনপির বিরুদ্ধে কথার যুদ্ধ শুরু করে। ঠিক যেমনটা পতিত আওয়ামী লীগ করেছিল। আমরা আশা করেছিলাম, ৫ আগস্ট-পরবর্তী রাজনীতি হবে সৌহার্দ্যপূর্ণ। রাজনীতিতে তর্ক হবে, কথার যুদ্ধ হবে। কিন্তু সেটা শালীনতা বজায় রেখে হবে। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অধিকতর বুদ্ধিবৃত্তিক উন্নতি ও জনবান্ধব কর্মসূচি নিয়ে প্রতিযোগিতা হবে। কিন্তু আমরা ৫ আগস্টের পর দেখলাম, বিএনপিকে লক্ষ্য করে অহেতুক আক্রমণ করা শুরু হলো। আওয়ামী লীগের সঙ্গে বিএনপির তুলনা শুরু হয়ে গেল। গত ১৫ বছরে বিএনপিও দমন, নির্যাতনের শিকার হয়েছে। তাদের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে দুই লাখের বেশি মামলা হয়েছে। আসামি ছিলেন ৩৬ লাখের বেশি। এই দলটির পাঁচ হাজার নেতা-কর্মী খুন হয়েছেন আওয়ামী লীগের হাতে। অথচ বলা হতে লাগল, বিএনপি আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে সফল হতে পারেনি। এটা বিএনপির একক ব্যর্থতা নয়। এটা আমাদের সম্মিলিত ব্যর্থতা। যদি ব্যর্থতা বলতেই হয়, তবে বলতে হবে, সব দল মিলেই আওয়ামী লীগের ফ্যাসিবাদ প্রতিরোধ করতে ব্যর্থ হয়েছে। আবার যখন সফল হয়েছে, তখন সবাই মিলেই সফল হয়েছে। এ ধরনের ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে এককভাবে সফল হওয়া সম্ভব হয় না। সবার সম্মিলিত অংশগ্রহণে ফ্যাসিবাদের পতন হয়। ইতিহাস তা-ই বলে। ফরাসি বিপ্লব থেকে ইরানের ইসলামিক বিপ্লব সব জায়গাতেই সমাজের সর্বস্তরের মানুষ নেমে এসেছিল বলেই তারা সফল হয়েছে। হেন কোনো কথা নেই, যেটা বিএনপিকে লক্ষ্য করে বলা হয়নি। এমনও বলা হয়েছে, মুজিববাদ ও জিয়াবাদ আর এই দেশে চলবে না। কিন্তু মজার বিষয় হচ্ছে, আওয়ামী লীগের লোকজন মুজিববাদের চর্চা করলেও দেশে জিয়াবাদ বলে কিছু নেই। বিএনপি জিয়াবাদ বলে কোনো রাজনীতির চর্চাও করে না। বিএনপি জিয়াউর রহমানের শুরু করা বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদের রাজনীতি করে। এটা বহুপক্ষীয় রাষ্ট্রভিত্তিক পরিচয় নির্মাণের রাজনীতি। এখন কেউ যদি বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদকে বাতিল করতে চায়, সেটা ভিন্ন কথা। তারা নতুন রাজনীতি শুরু করতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদকে জিয়াবাদ বলা অত্যন্ত বোকামি ও অজ্ঞতার পরিচয় বহন করে। পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে, তাদের উদ্দেশ্য হচ্ছে, যেকোনো প্রকারে বিএনপিকে কোণঠাসা করতে হবে। এটা করতে গিয়ে কোনো কোনো রাজনৈতিক গোষ্ঠী ও পক্ষ এবং তাদের নেতা-কর্মীর যেন হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছেন। এ রকম আচরণ তাঁদের জন্য মোটেও ইতিবাচক হচ্ছে না। বিএনপিকে মূল্যায়ন করবে দেশের জনগণ। খারাপ কাজ করলে জনগণ তার হিসাব নেবে। কিন্তু তারা সেটা মানতেও রাজি নয়। ভোট হলে বিএনপি আসবে এ ধরনের যুক্তি দেখিয়েই শেখ হাসিনা ফ্যাসিবাদ কায়েম করেছিলেন। লন্ডনের বৈঠক বিএনপিকে এ পরিস্থিতি থেকে উতরাতে সহায়তা করবে। কারণ, যাঁরা কঠোরভাবে আজেবাজে ভাষায় অহেতুক বিএনপির সমালোচনা করতেন, তাঁদের রাজনৈতিক ও নৈতিক পরাজয় হয়েছে বিএনপি ও সরকারের ঐকমত্যের কারণে। এখন ন্যূনতম সংস্কার করে সরকার নির্বাচনের প্রস্তুতি নেবে। সরকার যদি গড়িমসি করে বা নির্বাচন নিয়ে টালবাহানা করে, তবে যেকোনো পরিস্থিতির জন্য সরকারই দায়ী থাকবে। তাই ফেব্রæয়ারির টাইমলাইন থেকে সরকারের পক্ষে সরে যাওয়া কঠিন হবে। যদি-কিন্তু দিয়ে পার পাওয়া যাবে না। এ অবস্থায় আশা করা যায়, সহসাই দেশ নির্বাচনী পরিবেশের মধ্যে প্রবেশ করবে। ফলে যাঁরা এত দিন বিএনপি ঠেকাও কৌশল নিয়ে নানা ফন্দি এঁটেছিলেন, তাঁরা ক্রমশই হতাশার সাগরে নিমজ্জিত হতে থাকবেন। রাজনীতির মাঠেও তাঁরা নিজেদের জায়গা হারাবেন। রাজনীতি একদিকে সহজ, আবার অন্যদিকে এক কঠিন কাজ। এটা নির্ভর করে কে কীভাবে রাজনীতি করে। কেউ যদি সহজ রাজনীতির পথ পরিহার করে অহেতুক কুটিল ও ষড়যন্ত্রের রাজনীতি করে, তবে তারা নিজেরাই রাজনীতি থেকে হারিয়ে যায়। আওয়ামী লীগ ও জাসদ আমাদের সামনে রাজনীতি থেকে হারিয়ে যাওয়ার সবচেয়ে বড় উদাহরণ। যাঁরা পরিস্থিতি অনুধাবন না করে অযথাই নানা ষড়যন্ত্রের জালে নিজেদের আবদ্ধ করে অলীক, অবাস্তব স্বপ্নের জাল বোনা শুরু করেছিলেন, তাঁদের স্বপ্নভঙ্গ হয়েছে এই বৈঠকের কারণে।
ড. মারুফ মল্লিক রাজনৈতিক বিশ্লেষক
*মতামত লেখকের নিজস্ব




Your email address will not be published.

Comments are closed.


আজকের পত্রিকা
আজকের পত্রিকা
ফেসবুকে আমরা
পুরনো সংখ্যা
সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি রবি
 
১০১১১২১৩১৪১৫
১৬১৭১৮১৯২০২১২২
২৩২৪২৫২৬২৭২৮২৯
৩০  
Copyright © Dundeebarta 2024
ডান্ডিবার্তা