আজ শনিবার | ২ আগস্ট ২০২৫ | ১৮ শ্রাবণ ১৪৩২ | ৭ সফর ১৪৪৭ | বিকাল ৪:৩৩

মৎস্যজীবী দল নেতা হত্যা শোকে পাথর পুরো পরিবার

ডান্ডিবার্তা | ০১ আগস্ট, ২০২৫ | ১১:১২ পূর্বাহ্ণ

ডান্ডিবার্তা রিপোর্ট
স্ত্রী, দুই ছেলে ও তিন মেয়েকে নিয়ে জাহাঙ্গীর হোসেনের (৫৭) সংসার। অভাবের সংসারে পড়াশোনা হয়নি তাঁর। সম্পদ বলতে বাবার কাছ থেকে পাওয়া ভিটেমাটি ও বাড়ির পাশের বাজারে ছোট্ট একটি দোকানঘর। সেই দোকানঘরও বন্ধক দেওয়া। গত বুধবার নিজের সেই বন্ধকি দোকানের ভাড়া তুলতে গিয়ে খুন হন জাহাঙ্গীর হোসেন। জাহাঙ্গীরের বাড়ি নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার উপজেলার সালমদী নয়াপাড়া গ্রামে। তিনি মাহমুদপুর ইউনিয়ন মৎস্যজীবী দলের সহসাধারণ সম্পাদক ছিলেন। জাহাঙ্গীরের স্বজনেরা বলেন, গত বছরের আগস্টে মাহমুদপুর ইউনিয়ন বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক তোতা মিয়া প্রধান জাহাঙ্গীর হোসেনের কাছ থেকে বার্ষিক ১০ হাজার টাকায় দোকানঘরটি ভাড়া নিয়ে মাহমুদপুর ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির কার্যালয় গড়ে তোলেন। ভাড়া নিয়ে দ্ব›েদ্ব গতকাল সেই কার্যালয়ের ভেতরে মারধর করে জাহাঙ্গীরকে খুন করা হয়।
আজ বৃহস্পতিবার সকালে জাহাঙ্গীরের বাড়িতে গেলে প্রতিবেশী ও স্বজনদের ভিড় দেখা যায়। জাহাঙ্গীরের বৃদ্ধ মা আয়শা বেগম পাগলপ্রায় হয়ে বিড়বিড় করছিলেন। মৃত্যুর খবর শুনে বাড়িতে আসা জাহাঙ্গীরের ছোট বোন রেহানা ভাইয়ের শোকে বিলাপ করছেন। বাড়ির ভেতরে টিনের চৌচালা ঘর। ঘরে বড় মেয়ে লতিফা আক্তার ও ছোট মেয়ে আমিনা আক্তারকে সঙ্গে নিয়ে প্রতিবেশীদের কাছে নিজের দুঃখের জীবন নিয়ে আক্ষেপ করছিলেন জাহাঙ্গীরের স্ত্রী সেলিনা আক্তার। সেলিনা আক্তার বলেন, জীবনে অভাব ছাড়া কখনো সুখের মুখ দেখেননি তাঁর স্বামী। কৃষক বাবার ঘরে পড়াশোনার সুযোগ হয়নি। বিয়ের পর থেকে অন্যের জমি বর্গা নিয়ে চাষাবাদ করে সংসার চালিয়েছেন। অভাবের কারণে ছেলেমেয়েদেরও পড়াশোনা করাতে পারেননি। এর মধ্যে কয়েক বছর হলো হৃদ্‌রোগ আর কিডনিজনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েন। তারপর থেকে বাড়ির পাশের সালমদী বাজারে পৈতৃক সূত্রে পাওয়া দোকানঘরে মুদি মালামাল বেচাকেনা করেছেন। এভাবে তিন মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। বছরখানেক আগে ছোট ছেলেকে অবৈধপথে মালয়েশিয়ায় পাঠাতে গিয়ে দোকানের পুঁজি খুইয়েছেন। পাশের গ্রামের এক নারীর কাছে পুরো দোকানঘর বন্ধক রেখেছেন লাখ টাকায়। সেই দোকানঘরই আবার বছরে ১৬ হাজার টাকায় ভাড়া নিয়েছিলেন আবার মুদি মালামাল বিক্রির আশায়। কিন্তু পুঁজি না থাকায় গত বছরের আগস্টে স্থানীয় বিএনপি নেতা তোতা মিয়ার কাছে ভাড়া দেন। সেলিনা বলেন, ‘পোলারে বিদেশ পাঠাইতে যাইয়া দোকান বন্ধক ছাড়াও আরও ৪ লাখ টাকা ঋণ করছি। পোলায় বিদেশ গিয়া অবৈধ। কাম-কাইজ পায় না। ওনার (জাহাঙ্গীর) ওষুধ-পানি লাগে। ঋণের চাপ। বড় পোলারে লইয়া খেতখামারে কাম কইরা কোনো রকম সংসার চলতেছিল। দোকান বন্ধক দেওয়ার পর খাই না খাই বছরে ১৬ হাজার টেকা দোকান ভাড়া দিতে হয়। কিন্তু আমরা যাগোর কাছে দোকান ভাড়া দিসি, ওনারা কোনো টেকা দিতেছিল না। বাধ্য হইয়া তিন মাস ধইরা ছোড পোলা বিদেশ থেইকা বলতেছিল, পোলায় কিছু টাকা ব্যবস্থা কইরা দিব। হেই টেকায় মাল তুইলা যেন দোকানডা আমরা নিজেরাই চালাই। আমরা তো জানতাম না, এই দোকান ফেরত চাইতে গেলে ওরা আমার স্বামীরে এমনে পিডায়া মাইরা ফেলব।’ জাহাঙ্গীরের বড় ছেলে মো. রাসেল ভূঁইয়া বলেন, ‘ভাড়া না পাওয়ায় গত তিন মাস ধইরা আমরা তোতা মিয়ারে দোকান ছাড়তে বলতাছিলাম। উনি কোনোভাবেই টাকা দিতেছিল না। গত বুধবার সকালে আমি আর আব্বা দোকানে যাইয়া শাটারে কাম করাইতেছিলাম। আমরা চাইতেছিলাম, দোকানটা ঠিক কইরা নিজেরাই চালামু। আব্বারে রাইখা আমি বাড়ি আইসা পড়ি। ঘণ্টাখানেক পরে শুনি, তোতা মিয়া আর ওনার ভাই-ভাতিজারা মিল্লা আব্বারে পার্টি অফিসের শাটার ফালাইয়া পিটাইছে। আমি দৌড়াইয়া যাইয়া শুনি, তোতা মিয়ার লোকজন আব্বারে নিয়া হাসপাতালে গেছে। তারপর হাসপাতাল যাইয়া আব্বার লাশ দেখতে পাই।’ প্রত্যক্ষদর্শীর বরাতে রাসেল বলেন, ‘আব্বা শাটারের কাজ করার সময় তোতা মিয়া রিকশায় কইরা সেখানে আসে। তারপর উনি আব্বারে থাপ্পড় মারে। এডা নিয়া আব্বা প্রতিবাদ করলে ওনার ভাই-ভাতিজারা আব্বারে পার্টি অফিসে আটকায়া পিডায়া মাইরা ফেলছে।’ যদিও ঘটনার পর তোতা মিয়ার ছেলে খোকন প্রধান দাবি করেন, জাহাঙ্গীরকে মারধর করা হয়নি। তোতা মিয়ার সঙ্গে হাতাহাতির সময় তিনি আঘাতে মারা যান। এদিকে গতকাল বৃহস্পতিবার ঘটনাস্থল সালমদী বাজারে গেলে বিএনপির কার্যালয়টি বন্ধ পাওয়া যায়। বন্ধ ছিল আশপাশের দোকানপাটও। দিনে-দুপুরে হত্যার ঘটনাটি ঘটলেও স্থানীয় লোকজন এ বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি। কার্যালয়ের ৫০ গজ দূরের একটি মার্কেটের তত্বাবধায়ক আপন মিয়া মার্কেটের সামনের সড়ক পরিষ্কার করছিলেন। ঘটনার বিষয়ে তার কাছে জানতে চাইলে প্রথমে কথা বলতে চাননি। পরে তিনি বলেন, ‘জাহাঙ্গীর ভাই নিজেও বিএনপির লোক ছিল। ইদানীং পার্টি অফিসে আসতে দেখতাম। গতকাল হঠাৎ কইরাই চিল্লাচিল্লি শুনলাম। পরে দেখলাম ওনারে ধইরা রাস্তার হেপার (ওপারে) সুজন ডাক্তারের দোকানে নিয়া গেল।’ সালমদী বাজারের মধ্যে পল্লি চিকিৎসক সফিকুল ইসলাম ওরফে সুজনের মদিনা ফার্মেসি। গতকাল বৃহস্পতিবার ফার্মেসিটি বন্ধ পাওয়া যায়। পরে মুঠোফোনে সফিকুল ইসলাম বলেন, ‘একটি ইজিবাইকে করে জাহাঙ্গীরকে নিয়ে আসা হইসিল। রাস্তায় দাঁড়িয়েই আমি তাঁর পালস চেক করি। তখনো তাঁর হার্টবিট ছিল। কিন্তু একেবারেই নাজুক। সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যেতে বলি।’ ফার্মেসি লাগোয়া খলিলুর রহমানের চায়ের দোকানে বসে স্থানীয় লোকজন জাহাঙ্গীরের মৃত্যু বিষয়ে আলাপ করছিলেন। খলিলুর রহমান নিজেকে জাহাঙ্গীরের দূরসম্পর্কের আত্মীয় পরিচয় দিয়ে বলেন, ‘তোতা মিয়ার ভাতিজা জাহাঙ্গীর আর বিএনপি নেতা হাশেম জাহাঙ্গীরকে ডাক্তারের কাছে নিয়া আসছিল। ওনারা আমার দোকান থেইকা পানি নিয়া জাহাঙ্গীরের মাথায় দিসে।’ আড়াইহাজার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা (আরএমও) আশরাফুল আমিন বলেন, ওই ব্যক্তিকে মৃত অবস্থায় হাসপাতালে আনা হয়। তাঁর মাথায় আঘাতের চিহ্ন ছিল। নারায়ণগঞ্জের জ্যেষ্ঠ সহকারী পুলিশ সুপার (গ-সার্কেল) মেহেদী ইসলাম বলেন, সকালে নারায়ণগঞ্জ ১০০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালে নিহতের ময়নাতদন্ত হয়েছে। এ ঘটনায় নিহতের স্ত্রী সেলিনা আক্তার বাদী হয়ে একটি মামলা করেছেন। মামলায় নয়জনের নাম উল্লেখ ছাড়াও অজ্ঞাতনামা আট থেকে ১০ জনকে আসামি করা হয়েছে। বিকেল পর্যন্ত এ ঘটনায় কাউকে গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়নি।

 




Your email address will not be published.

Comments are closed.


আজকের পত্রিকা
আজকের পত্রিকা
ফেসবুকে আমরা
পুরনো সংখ্যা
সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি রবি
 
১০
১১১২১৩১৪১৫১৬১৭
১৮১৯২০২১২২২৩২৪
২৫২৬২৭২৮২৯৩০৩১
Copyright © Dundeebarta 2024
ডান্ডিবার্তা