আজ মঙ্গলবার | ২২ জুলাই ২০২৫ | ৭ শ্রাবণ ১৪৩২ | ২৬ মহর্‌রম ১৪৪৭ | সকাল ৯:৪৯

মুক্তিপনে জিম্মিদশা থেকে মুক্ত ৩ যুবক

ডান্ডিবার্তা | ০৩ এপ্রিল, ২০২৩ | ১১:৫৫ পূর্বাহ্ণ

ডান্ডিবার্তা রিপোর্ট আড়াইহাজার উপজেলায় শক্তিশালী নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছে আন্তর্জাতিক মানবপাচার চক্র ও তাদের স্থানীয় এজেন্টরা। মানবপাচারকারী চক্রের ভয়ংকর ফাঁদে পা দিয়ে সর্বশান্ত হচ্ছে গ্রামের তরুণ ও যুবসমাজ। দালালরা ফুসলিয়ে আড়াইহাজার থেকে তরুণ যুবকদের মায়ানমার পর্যন্ত নিয়ে আটকে রাখছে। সাড়ে ৪ লাখ টাকা মুক্তিপণ না দিলে সেই তরুণদের ভাগ্যে ঘটছে নির্মম পরিণতি। মুক্তিপণ না দিলে কেটে ফেলার হুমকি দিচ্ছে দালালরা। মেঘনা তীরের বিশনন্দি ইউনিয়নের কয়েকটি গ্রামে ঘরে ঘরে চলছে মাতম। দালালচক্রের ভয়ে পাচার হয়ে যাওয়া তরুণ ও যুবকদের ব্যাপারে মুখ খুলতে ভয় পাচ্ছেন তাদের অভিভাবকগণ। জনপ্রতি ১ লাখ টাকা করে মুক্তিপণ দিয়ে গত বৃহস্পতিবার দালালচক্রের জিম্মিদশা থেকে বাড়িতে ফিরে এসেছে তিন যুবক। এরা হলো বাদশা মিয়া, সুমন মিয়া ও নাজমুল। গত ১৭ থেকে ২০ মার্চের মধ্যে আড়াইহাজারের কড়ইতলা, রামচন্দ্রদী, মানিকপুর, চৈতনকান্দা, দয়াকান্দা, টেটিয়া ও শম্ভুপুরা থেকে অন্তত ৩০ জন যুবক পাচার হয়েছে। সাতটি গ্রামজুড়ে চলছে শোকের মাতম। সন্তানকে ফেরত পেতে অভিভাবকগণ হয়ে পড়েছেন দিশেহারা। জানা গেছে, প্রথমে টাকা লাগবে না বলে দালালচক্র যুবকদের মায়ানমার, উখিয়া বা কক্সবাজারের কোন গোপান আস্তানায় নিয়ে আটকে রাখে। এরপর তাদেরকে জিম্মি করে জনপ্রতি ৪ থেকে সাড়ে ৪ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে। জানা গেছে, দালালচক্রের কাছে আটক ৩০ জনের মধ্যে ৬ জনের নাম মিলেছে। এরা আপাতত আটক আছে টেকনাফ এলাকায়। এরা হলো আড়াইহাজারের কড়ইতলার বিল্লাল, জুয়েল, আব্দুল্লাহ হাসান, আমির হোসেন, ইয়াসিন ও শাহপরান। ওরা টেকনাফে কালু দালালের কাছে জিম্মি আছে। ত্রিশ জনের মধ্যে ছয় জনের নাম প্রকাশ পেলেও বাদবাকিদের নাম প্রকাশে ভয় পাচ্ছেন অভিভাবকগণ। ভয়ের কারণ- নাম ঠিকানা প্রকাশ করলে দালালচক্র আটক যুবকদের নির্মমভাবে হত্যা করতে পারে। আড়াইহাজার সদরের বড় দালাল হচ্ছে আবু সাঈদ। তার বাড়ি নরসিংদী জেলার ফজলুরকান্দি গ্রামে। এই এলাকাটি পড়েছে আড়াইহাজার ও নরসিংদী জেলার সীমানার মধ্যবর্তী স্থানে। তাই মানবপাচার চক্রের বড় দালাল আবু সাঈদকে কেউ সহজে খুঁজে পায় না। টেকনাফে ভয়ংকর কালু দালালের আস্তানায় আটকে থাকা আব্দুল্লাহ হাসানের মা ও আমির হোসেনের ভাই আলী হোসেন জানান, দালালরা প্রতিনিয়ত আমাদের ফোন করে সাড়ে ৪ লাখ করে টাকা চাইছে। এই টাকা না পাঠালে আটক যুবকদের হত্যা করা হবে। হতদরিদ্র মানুষগুলো দিন আনে দিন খায়। তাঁরা সাড়ে ৪ লাখ টাকা চোখেও দেখেনি। তাঁরা এত টাকা পাবে কোথায়? তাই ঘরে ঘরে মাতম চলছে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, একজন যুবক পাচার করতে পারলে ক্ষুদে দালাল কমিশন পায় ৫ হাজার টাকা। মানিকপুর, রামচন্দ্রদী, চৈতনকান্দা ও দয়াকান্দা গ্রামে ক্ষুদে দালালদের আনাগোনা বেশি। ওরাই গ্রামের সহজ সরল কিশোর যুবকদের টোপ দেয়। দালালচক্র যেনতেন টোপ দেয় না। আবার ক্ষুদে দালালরাও বড় দালালদের ফাঁদে পড়ে। বড় দালালের নির্দেশ ঠিকমত পালন না করলে ক্ষুদে দালালদেরকেও ওরা ছাড়ে না। রামচন্দ্রদীর চিহ্নিত ক্ষুদে দালাল শরীফ, পারভেজ ও সফর আলী এবার মানবপাচার করতে গিয়ে নিজেরাই ফাঁদে পড়ে যায়। বড় দালালরা তিন ক্ষুদে দালালকে মায়ানমার পাঠিয়ে আটক করেছে। ১ লাখ টাকা মুক্তিপণ দিয়ে ক্ষুদে দালাল শরীফ ফিরে এসেছে। ক্ষুদে দালালরা খুবই আকর্ষণীয় টোপ দেয়। ‘আরে মিয়া এক টাকাও লাগবো না। তুমি খালি কয়টা জামাকাপড় লইবা। ব্যস্ বাদবাকি দায়িত্ব আমাগো। গাড়িতে চইড়া কক্সবাজার যাইবা। দুই দিন কক্সবাজার সমুদ্র দেখবা। হোটেলে থাকবা। একটু মউজ ফুর্তি করবা। এরপর প্রথমে বড় ট্রলারে কইরা নাফ নদী পাড়ি দিয়া সমুদ্রের ছোট জাহাজে উঠতে হবে। ছোট জাহাজ থেকে বড় জাহাজে উঠলেই সব চিন্তা শেষ। তুমি মালয়েশিয়া পৌঁছাইয়া যাইবা। সেখানে আমাগো কোম্পানির লোক আছে। ভালা চাকরিতে লাগাইতে একমাস সময় লাগে। কোন সমস্যা নাই থাকা খাওয়া ফ্রি। তবে শর্ত অইলো কাজে লাগলে মাসে মাসে আমাগো টাকা শোধ কইরা দিবা। আর বাড়িতে টাকা পাঠাইবা। তোমার আব্বায় কত কষ্ট কইরা তোমারে বড় করছে। তোমার কি পরিবারের লইগা কোন দায়িত্ব নাই। দায়িত্ব থাকলে চুপি চুপি চলো আমাগো লগে। কাউরে কিছু কইবা না। মালয়েশিয়া গিয়া খালি টাকা পাঠাইবা। দেখবা তোমার বাপ মায় কত খুশি অয়। আকাশে চাদ উঠলে সবাই দেখবো।’ দালালদের এমন মিষ্টি কথায় পড়ে কিশোর তরুণরা পটে যায়। কারণ বেকার ছেলেপেলেগুলো সত্যিকারভাবেই বাপ মার কষ্ট সহ্য করতে পারে না। জোয়ান পোলা পরিবারের লইগা কিছু করতে চায়। কিন্তু পরিবারের মঙ্গলের কথা ভেবে ওরা যে দালালচক্রের চোরাবালির ফাঁদে পা বাড়াচ্ছে, সে কথা সহজে বুঝতে পারে না। কারণ দু-একজন ছেলে এভাবেই মালয়েশিয়া গিয়ে ভালো কাজ করছে। ঐ ছেলে যে দালালচক্রের নিজস্ব লোক, সে কথা গ্রামের সহজ সরল একজন কিশোর বুঝবে কিভাবে। দালালদের ইমোশনাল কথাবার্তায় বেকার ছেলেরা একটা রিস্ক নেয়ার জন্য তৈরি হয়ে রাতের আঁধারে পিতামাতাকে কিছু না বলে কিছু জামাকাপড় সম্বল করে দালালচক্রের পেছনে পেছনে ছোটে মালয়েশিয়া যাওয়ার উদ্দেশ্যে। দালালচক্র যে ওদেরকে জিম্মি করে টাকা দাবি করবে, সে কথা ঘুণাক্ষরেও টের পায় না কিশোর তরুণরা। মালয়েশিয়ার জঙ্গলে নিয়ে বা জাহাজে থাকতেই দালালচক্র ওদেরকে মারধর করে হাত পা বেঁধে রাখে। এরপর দেশে ফোন করে বাপ মার কাছে টাকা দাবি করে। টাকা না দিলে ওই কিশোরকে হয় জাহাজ থেকে সমুদ্রে নিক্ষেপ করে। না হয় মালয়েশিয়ার জঙ্গলে পেট কেটে মেরে ফেলে। বা গভীর জঙ্গলে ছেড়ে দেয়। সাপের কামড় বা বিচ্ছুর কামড়ে ওই হতভাগ্য তরুণের মৃত্যু ঘটে। মানবপাচার সমন্ধে অভিবাসী ফোরাম বিশনন্দির মজিবুর রহমান সরকার ও ডা. শেখ নেয়ামতউল্লাহ সুমন জানান, এই ইউনিয়নের মানিকপুর ও চৈতনকান্দা গ্রাম থেকে দালালচক্রের ফাঁদে পড়ে ৩০ জন যুবক জিম্মিদশায় আছে। এদের মধ্যে কয়েকজন ফিরে এসেছে। কেউ কেউ আটকা পড়ে আছে। আমরা গ্রামে গ্রামে হেঁটে হেঁটে জনগণকে মানবপাচারকারী দালালচক্র সম্পর্কে সতর্ক করছি। তাদেরকে বোঝাচ্ছি। বিশনন্দি ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান সিরাজুল ইসলাম সিরাজ বলেন, আমরা প্রশাসনকে অনুরোধ করবো তাঁরা যেনো মানবপাচারকারী চক্রের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। দালালচক্র নিরীহ যুবকদের নিয়ে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিচ্ছে। ওকাপ এর আড়াইহাজার উপজেলার ফিল্ড অফিসার আমিনুল হক জানান, আমরা দীর্ঘদিন ধরে আড়াইহাজারে মানবপাচারকারী চক্রের বিরুদ্ধে কাজ করে আসছি। সম্প্রতি হঠাৎ করেই যুবক শ্রেণি দালালচক্রের ফাঁদে পা বাড়াচ্ছে। আমরা যুবসমাজকে বুঝিয়ে ওই চক্রের ফাঁদ থেকে ফেরানোর চেষ্টা চালাচ্ছি। আড়াইহাজার থানার নবাগত ওসি মুহাম্মদ এমদাদুল হক তৈয়ব বলেন, সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে আমি অবশ্যই আইনগত ব্যবস্থা নিব। তাছাড়া আমি গ্রামবাসীদের বলবো আপনারা সতর্ক থাকুন। আপনাদের সন্তানদেরকে এভাবে বিপদের মুখে ঠেলে দিবেন না।




Your email address will not be published.

Comments are closed.


আজকের পত্রিকা
আজকের পত্রিকা
ফেসবুকে আমরা
পুরনো সংখ্যা
সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি রবি
 
১০১১১২১৩
১৪১৫১৬১৭১৮১৯২০
২১২২২৩২৪২৫২৬২৭
২৮২৯৩০৩১  
Copyright © Dundeebarta 2024
ডান্ডিবার্তা