আজ শনিবার | ৯ আগস্ট ২০২৫ | ২৫ শ্রাবণ ১৪৩২ | ১৪ সফর ১৪৪৭ | ভোর ৫:৪৭

গণঅভ্যুত্থানের স্বপ্ন কি চুরি হয়ে যাচ্ছে?

ডান্ডিবার্তা | ২৮ ডিসেম্বর, ২০২৪ | ১০:৩৪ পূর্বাহ্ণ

ড. মো: মাহবুবুল আলম
এক আলোচনায় বর্তমানে আলোচিত এক ব্যারিস্টার বলেছেন, তিনি ১৬ই ডিসেম্বর বিজয় দিবস মানেন না। মানেন না কারণ মোদিজি এই দিনটিকে পাকিস্তানের বিপক্ষে ইন্ডিয়ার বিজয় দাবি করেছেন। মানেন না কারণ পাকিস্তানি বাহিনী ইন্ডিয়ার সশস্ত্র বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেছিলেন। প্রকান্তরে এই বক্তা মোদিদের দাবির পক্ষে সাফাই গেয়েছেন। কিন্তু এই ব্যক্তির সেই বক্তব্যের কৈফিয়ত চাওয়া হয়নি। আরেক আয়নাঘরে থাকা মুক্তিপ্রাপ্ত রাজনৈতিক পরিবারের সন্তান জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের কথা বলেছিলেন। একটি ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলের ছাত্র সংগঠনের একটি বিশ্ববিদ্যালয় সভাপতি অতি স¤প্রতি পূন:প্রকাশিত জাতীয় দৈনিকের লেখায় ২৪ জুলাই এর বিজয় তাদের পরিকল্পিত বলে দাবি করেছেন। সমন্বয়কবৃন্দ সবকিছুতেই তাদের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন, কিন্তু এব্যাপারে তাদের এখন পর্যন্ত নীরব দেখেছি। একই ছাত্র সংগঠনের এক সাবেক ছাত্রনেতা, বর্তমানে বিদেশি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক বাংলাদেশের একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলে দেশের প্রধানতম দুইটি রাজনৈতিক দলের রাজনৈতিক নীতি ও স্ট্রাট্রেজি সম্পর্কে সমালোচনা করেছেন। তিনি ঐ দুটি দলের প্রতিষ্ঠাতা সম্পর্কে ভালো মন্তব্য করলেও, দল দুটি যে তাদের নীতিগত অবস্থান মেনে চলেন নাই সেই সম্পর্কে বলেছেন। খুবই কৌতূলোদ্দীপকভাবে এই শিক্ষক এবং সাবেক ছাত্রনেতা বাংলাদেশের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের পুনর্বাসন প্রসঙ্গে জুলাই অভ্যুত্থানে তাদের অনুশোচনার ব্যাপারে বলেছেন। অনুষ্ঠানের উপস্থাপক-সাংবাদিক বুদ্ধিজীবীকে এই প্রশ্ন করেন নাই ৭১-প্রশ্নে সেই নেতার রাজনৈতিক দলের অবস্থান কী ছিল? ‘২৪-এর পতিত দলটি যদি ক্ষমা চাওয়া ছাড়া বাংলাদেশের রাজনীতি করতে না পারে, বাংলাদেশে একাত্তরের যুদ্ধ অপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত দলটি মুক্তিযুদ্ধ প্রশ্নে স্পষ্ট অবস্থান ছাড়া কীভাবে বাংলাদেশে রাজনীতি করছে? রাজনৈতিক সংস্কারের প্রথম ধাপ হওয়া উচিত বাংলাদেশ প্রশ্নে ও গণতন্ত্রের প্রশ্নে দলগুলোর অবস্থান। যেটি আমাদের তরুণ ছাত্র নেতৃত্ব হয়তো জিজ্ঞেস করতে ভুলে গিয়েছে। এটি পরিষ্কার অন্তর্বতীকালীন সরকারের শ্লথ গতি, আপাতদৃষ্টিতে মুক্ত গণমাধ্যমের বাতাবরণে একাত্তরের পরাজিত শক্তির প্রোপাগান্ডা মেশিন হয়ে কাজ করছে অনেক মিডিয়া হাউজ। বাংলাদেশের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঐ দলটির নেতাকর্মীদের সংবাদ এবং তার পরিপ্রেক্ষিতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তাদের কর্মী বাহিনীর মন্তব্য স্পষ্ট সমাজের প্রতিটি স্তরে তাদের বার্তা পৌঁছে দেওয়ার মাধ্যম হিসেবে কাজ করছে বাংলাদেশের গণমাধ্যম। সুতরাং দেশের গণমাধ্যম বা কিছু সাংবাদিক সাংবাদিকতার মুক্তনীতি নিজের কাজে ব্যবহার করছেন না বা নিজকে প্রকাশ না করে রাজনীতিকে নিজের আশ্রয় হিসেবে বেছে নিয়েছেন। বিশেষ করে ইলেকট্রনিক গণমাধ্যমগুলো রাজনৈতিক চরিত্র পরিবর্তন করেছেন বলে মনে হয় না। শুধু পরিবর্তন হয়েছে তাদের ব্যক্তি বা গোষ্ঠীবন্দনা। গণমাধ্যমে এই আলোচনা আছে যে, ঐ ধর্মীভিত্তিক রাজনৈতিক গোষ্ঠীর বর্তমান নেতৃত্ব যুদ্ধাপরাধের দায় নিবেন না। কারণ তারা কেউ যুদ্ধ অপরাধের সাথে জড়িত ছিলেন না। কিন্তু রাজনীতিতে নীতি পরিবর্তন না করে শুধু নেতার পরিবর্তনে কোনো রাজনৈতিক দল তার অপরাধের দায়মুক্তি পেতে পারেন কিনা? স্বাধীন গণমাধ্যম নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য সঠিক প্রশ্ন উত্থাপিত হবে না। বাংলাদেশের সাংবাদিকরা কি কোনো কিছু আঁচ করছেন, তাই সঠিক প্রশ্ন না করে কাউকে কাউকে ফ্রি স্পেস দিচ্ছেন? কোনো ছাত্র সংগঠনের কোনো সভাপতি যখন ‘২৪ গণঅভ্যুত্থানের জয় নিজের বলে দাবি করেন তখন ছাত্র সমন্বয়কদের অতি অবশ্যই এব্যাপারে জাতির কাছে বার্তা দেওয়া জরুরি। যদি তার দাবি সঠিক হয়ে থাকে তাহলে জাতির কাছে সেটা হবে অনেক বেদনার। আর যাই হোক, এখনো বাংলাদেশের অনেক জনগণ যারা গণঅভ্যুত্থানে জীবন দিয়েছেন, সাহস নিয়ে দাঁড়িয়েছেন, ৭১ অপরাধে কোনো দলের আহŸানে সাড়া দিতেন বলে মনে হয় না। যে সমস্ত রাজনৈতিক দলগুলো স্বৈরাচারী সরকারের বিরুদ্ধে বছরের পর বছর বিপ্লব করে রাজনৈতিক কারণে কারাবরণ করেছেন, সরকারের স্বরূপ সম্পর্কে জনগণকে অবহিত করেছেন, গণমানুষকে আন্দোলনে শরীক হতে বলেছেন, তাদের ক্ষমতা ও আত্মত্যাগকে অবজ্ঞা করা হয়েছে এই দাবির মাধ্যমে। রাজনৈতিক দলগুলোর সংস্কারের দ্বিতীয় ধাপ হওয়া উচিত দলগুলোর ভেতরে দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি। তবে এক্ষেত্রেও আশাব্যঞ্জক কোনো অগ্রগতি হচ্ছে বলে মনে হচ্ছে না। এদেশের একটি বড় রাজনৈতিক দলের নেতারা অলরেডি ধরে নিয়েছেন তারা ক্ষমতায় আসছেন। কেন্দ্র থেকে ব্যবস্থা নেয়া সত্তে¡ও মাঠ পর্যায়ের চিত্র হতাশাজনক। নেতাকর্মীদের সাময়িক বহিষ্কার এই চিত্র পাল্টাতে পারবে বলে এখন আর মনে হয় না। যদি না দলটি কেন্দ্র থেকে মাঠ পর্যন্ত এই বার্তা দিতে পারে যে এক নতুন চেহারার পরিবর্তিত বাংলাদেশ বিনির্মাণে দলটি সক্রিয় হবে। দলটির বিরোধী শিবির ইতিমধ্যে মাঠ পর্যায়ে কিছু কর্মীর বিশৃঙ্খল আচরণ, অবৈধ উপায়ে আর্থিক সংশ্লিষ্টতার ইস্যুটি সামনে নিয়ে এসেছেন। বৈষম্যবিরোধী একজন ছাত্র নেতা, যিনি একটি রাজনৈতিক দল গঠনের প্রক্রিয়ার প্রধান ব্যক্তি বিভিন্ন গণমাধ্যমে তার সাক্ষাৎকারে এই বিষয়টি তুলে ধরতে চেয়েছেন। যদিও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র সংগঠনের ব্যানারে যে রাজনৈতিক দল গঠনের প্রক্রিয়া চলছে, তার আর্থিক সংস্থান কীভাবে চলছে, আলোচনা, সভা সংগঠন, কমিটি গঠন-নিশ্চয় শুধুমাত্র কর্মীদের মাসিক চাঁদার ভিত্তিতে হচ্ছে না, এটি নিশ্চিত। রাজনৈতিক দলগুলোর আর্থিক ব্যবস্থাপনা নিয়ে এদেশের অন্য দলগুলোর মতো অস্বচ্ছ প্রক্রিয়া অনুসরণ করলে, নতুন দলগুলোর কাছ থেকে নতুন কিছু পাওয়ার প্রত্যাশা কমে যায়। এদিক দিয়ে অবশ্য ভালো অবস্থানে আছে ধর্মের নামে রাজনীতি করা দলগুলো। পাবলিক পারসেপশন আছে ঐ দলগুলোর নেতাকর্মীরা কোনো আর্থিক অব্যবস্থাপনায় জড়িত না। তাদের নেতাকর্মীরা সুশৃঙ্খল এবং এটি অস্বীকার করার উপায় নেই। তবে তাদের ব্যাপারেও পাবলিক পারসেপশন আছে যে, দলটি যতো না রাজনৈতিক দলগুলোর মতো পরিচালিত হয়, তারচেয়ে বেশি পরিচালিত হয় একটা করপোরেট প্রতিষ্ঠানের মতো। এই ধরনের দলে থাকার সুবিধা হলো কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তা, অস্বচ্ছল সদস্যদের জন্য রয়েছে মাসোহারা-ভিত্তিক ব্যবস্থা। বাংলাদেশের কোন সরকার নিরপেক্ষভাবে সেসব আর্থিক প্রতিষ্ঠান এদের পৃষ্ঠপোষকতা করেন তাদের আর্থিক সংশ্লিষ্টতা এবং মুসলিম দেশগুলো থেকে আসা করপোরেট বা সামাজিক খাতে আসা অর্থের সুস্পষ্ট বিলিবন্টন নিয়ে গবেষণা করেন না। গণমাধ্যমগুলো এই প্রশ্ন তুলে না। সুতরাং সাধারণ মানুষের জন্য এ দলগুলো বিপক্ষ দলগুলোর বিরুদ্ধে একটা প্রশ্ন তুলতে পারলেও, নিজেদের আর্থিক সংশ্লিষ্টতা সুকৌশলে এড়িয়ে যায়। নতুন রাজনৈতিক দলগুলোর আর্থিক সংশ্লিষ্টতা কাদের সাথে সে ব্যাপারটাও স্পষ্ট হওয়া প্রয়োজন। সুতরাং রাজনৈতিক সংস্কার চাইলে দলগুলোর আর্থিক ব্যবস্থাপনা স্পষ্ট করতে হবে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের একটি বড় প্রচারণা ছিলো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কোনো লেজুড়বৃত্তিক রাজনীতি থাকবে না। কিন্তু দেখা গেলো ধর্মকে উপজীব্য করে রাজনীতি করা একটি দল কিছু ক্যাম্পাসে তাদের কমিটি ঘোষণা করলো। কিন্তু কোনো প্রতিবাদ বৈষম্যবিরোধী সমাজ থেকে দেখা গেলো না। ইতিমধ্যে তারা নিজেই রাজনৈতিক দল করার ঘোষণার মাধ্যমে তাদের দাবি আর নৈতিকভাবে ধোপে টিকে কিনা তা একটি প্রশ্ন বটে। তাদের এই কালক্ষেপণে অনৈতিক সুবিধা যদি কেউ পেয়ে থাকে তবে সেই ছাত্র সংগঠনটি, যারা ইতিমধ্যেই বিভিন্ন ক্যাম্পাসে নীরবে তাদের কর্মী সংগঠনের কাজটি করে ফেলেছে। সংগঠনটির ছাত্র নেতৃত্বের দাবি অনুযায়ী বৈষম্য বিরোধী ছাত্র নেতৃত্ব তাদের খুব কাছের মানুষজন। মিডিয়াগুলোতে তাদের মিথস্ক্রিয়া অবশ্য তার সাক্ষ্য বহন করে। উদারনৈতিক দেশের প্রত্যাশা নিয়ে শুরু গণআন্দোলন হারিয়ে যাবার উপক্রম হয়েছে কিছু রাজনৈতিক সুবিধাভোগীর অবিমৃষ্যকারী ইতিহাস রচনার প্রেক্ষিতে। সুতরাং এব্যাপারে জুলাই আন্দোলনের নায়কদের স্পষ্ট বক্তব্য দরকার। বাংলাদেশের সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিমÐল পরিবর্তন করার এই প্রচেষ্ঠা তাদের নতুন বন্দোবস্তের সাথে সম্পর্কিত কি-না সে ব্যাপারে খোলাসা করা দরকার। না হলে একটি দলের চাঁদাবাজি নিয়ে সমাজে যতো কথা আছে, কারো মসজিদ দখল, বিশ্ববিদ্যালয়ের হল দখল, পেশাজীবিদের প্লাটফর্ম দখল- এ সম্পর্কিত প্রশ্নে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখছি না কেন। জনসাধারণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে যে বিজয়, তা যখন একটি রাজনৈতিক দল চুরি করে নেয় তবে প্রশ্ন উঠা স্বাভাবিক বৈকি। তবে এটাও ঠিক সব রাজনৈতিক দলগুলোর নিজস্ব দলে সুশাসন নিশ্চিত করা ছাড়া জনগণের মাঝে আস্থা ফেরানোর কাজটি সহজ হবে না।
লেখক-অধ্যাপক, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়

 




Your email address will not be published.

Comments are closed.


আজকের পত্রিকা
আজকের পত্রিকা
ফেসবুকে আমরা
পুরনো সংখ্যা
সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি রবি
 
১০
১১১২১৩১৪১৫১৬১৭
১৮১৯২০২১২২২৩২৪
২৫২৬২৭২৮২৯৩০৩১
Copyright © Dundeebarta 2024
ডান্ডিবার্তা