আজ শুক্রবার | ৮ আগস্ট ২০২৫ | ২৪ শ্রাবণ ১৪৩২ | ১৩ সফর ১৪৪৭ | রাত ৯:২৪

বাংলাদেশকে ‘ব্যর্থ রাষ্ট্র’ প্রমাণের চেষ্টা করছে কারা?

ডান্ডিবার্তা | ০৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ | ৯:২৯ পূর্বাহ্ণ

খাজা মাঈন উদ্দিন
আমরা কি তাহলে সুযোগ হাতছাড়া করা জাতি?’ প্রশ্নটি এসেছে এক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকের কাছ থেকে। গত কিছুদিনের ঘটনাপ্রবাহ ও বিগত ৫০-৫৫ বছরের জাতীয় অভিজ্ঞতার আলোকেই হয়তো তাঁর এ হতাশা মেশানো জিজ্ঞাসা। এই লেখকের সঙ্গে ঘরোয়া আলোচনায় সদ্য অবসরে যাওয়া দেশের জন্য নিবেদিতপ্রাণ এক ঊর্ধ্বতন সরকারি কর্মকর্তার প্রশ্নবোধক পর্যবেক্ষণ: বাংলাদেশকে ব্যর্থ রাষ্ট্র বানানোর ‘ষড়যন্ত্রমূলক প্রকল্পটি’ও কি চালু নেই? শহরে ছোট ছোট অসংখ্য প্রতিবাদ ও দাবিনামার সমাবেশ, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সমালোচনার ঝড়, ‘আফসোস লীগের’ মাতম, কর্তৃপক্ষের প্রতি নানা হুমকি এবং জনজীবনে হতাশার ফিসফিস আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। এই বাস্তবতায় বসবাস করে অনেক প্রশ্নই অসংখ্য মানুষের দৈনন্দিন কথাবার্তায় উঠে আসছে। এগুলোর সংক্ষিপ্ততম উত্তর হচ্ছে—ইতিহাস পুনরাবৃত্তি করে না। আরও সাদামাটাভাবে বললে, আমাদের জাতীয় জীবনে আশা করি নতুন ঘটনাই ঘটবে। সে কারণে ২০২৪ সালের বিপ্লবী রাজনৈতিক পরিবর্তন-পরবর্তী রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাও নতুন নতুন ভাবনা, বয়ান, পরিকল্পনা ও কাজের দাবি রাখে। অন্যথায় এবারের সম্ভাবনা আসলেই মাঠে মারা যেতে পারে। তবে সুস্থ-সংসারাভিজ্ঞ চিন্তার আলোকে এটাও বলা যায়, অতি স¤প্রতি বাংলাদেশে যা ঘটেছে এবং ঘটছে, তা ঘটারই কথা। আমরা হয়তো আরেকটু ভিন্ন কিছু করতে এবং ভিন্ন ফলাফল পেতে পারতাম ইতিমধ্যেই। আচ্ছা বলুন তো, রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের বারোটা বাজলে খুশি হওয়ার অথবা আহাম্মকের মতো কাজ করে জাতীয় ক্ষতিতে অবদান রাখার লোকের কি অভাব আছে? অতএব নিশ্চিত থাকুন, যে যা করার, তারা তো তা করবেই। যিনি বা যাঁরা কীভাবে দেশের পক্ষে অবদান রাখছেন বা বিপক্ষে চক্রান্ত করছেন এবং কেন করছেন, সেটা বুঝলে তাদের পরিচয় করিয়ে দেওয়ার দরকার না–ও হতে পারে। ফ্যাসিবাদী শাসক হাসিনার পতনের ছয় মাসের মধ্যেই নব্য বোদ্ধাদের ধারণা হয়েছে, বিপ্লবের পর রক্তক্ষয় এবং নৈরাজ্যের দৃষ্টান্তে মানব ইতিহাস ভরে আছে। সা¤প্রতিক দশকে আরব বসন্তের পরিণতি হিসেবে দেশে দেশে গৃহযুদ্ধ দেখা গেছে। আমাদের দেশেও সে রকম কিছু ঘটতে পারে বলে তাদের একটা অংশের মধ্যে ধারণা জন্মেছে বলে মনে হচ্ছে। আর এই সরকারের সাফল্যের দৃষ্টান্ত থাকলেও সেগুলো আমাদের চোখে তা কমই পড়ছে। আধুনিক বিশ্বে চীন বিপ্লব, ইরানের ইসলামি বিপ্লব, দক্ষিণ আফ্রিকায় শ্বেতাঙ্গ শাসনের অবসান এবং যুক্তরাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক বিপ্লব মোটামুটিভাবে ঘোষিত লক্ষ্যের দিকে গেছে। ফরাসি বিপ্লব সফল হতে সময় লেগেছে অনেক। ২০২৪-এর রাজনৈতিক পরিবর্তন যে একটি স্বতঃস্ফূর্ত কিন্তু অগোছালো বিপ্লব, তা স্বীকার করতে অনেকেই ভয় পান। সেই ভয়টা অনিশ্চয়তা থেকে এসেছে। সেই ভয়টা নৈরাজ্যকে শান্তিতে রূপান্তরের চ্যালেঞ্জকে আকাশছোঁয়া স্তরে নিয়ে যাচ্ছে। এখন হাসিনার পতন ঘটানোর কৃতিত্ব অথবা বিপ্লব বর্গা দেওয়া নিয়ে বাহাস দেখা যায় রাজনীতির বাজারে। ‘ডিম আগে নাকি মুরগি আগে’র মতো সংস্কার আগে নাকি নির্বাচন আগে—সে তর্কে জড়িয়ে জাতির বন্ধুরা পর্যন্ত বড়ই অস্থির হয়ে উঠেছেন। সংস্কার ও নির্বাচন—উভয়ই যে হতে হবে এবং রাষ্ট্রের দায়িত্ব যার যার জায়গা থেকে প্রত্যেকের—এই তর্কাতীত বিষয় কে কাকে বোঝাবে? অর্থনীতি ঠিকঠাক করা, জনগণের ক্ষমতা ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনা সুসংহতকরণ, পরবর্তী গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও সংস্কৃতি নির্ধারণ, সংস্কারের রাজনৈতিক রূপরেখা ও প্রতিশ্রæতি এবং জনকল্যাণের এজেন্ডার চেয়ে বরং সংঘাতময় শাসনকালে প্রচলিত বাগ্‌বিতÐাই যেন জাতীয় জীবনের মুখ্য বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাকে ‘রিসেট’ করার চেষ্টাকে কঠিন পাপের কাজ মনে করতেই পারে ফ্যাসিবাদের দোসরেরা। কারণ, ২০২৪-এর ঐতিহাসিক সুযোগে একটি গণতান্ত্রিক ও উন্নত বাংলাদেশের সূচনা হলে তাঁদের কি মুখ থাকে? আশার কথা, তাঁদের গায়ে জ্বালা ধরাটাই বলে দেয়, এবারের বিপ্লবের সুযোগ মোটেই হাতছাড়া হয়নি। তবে শুভশক্তির দায়িত্ব জন–আকাঙ্ক্ষা এবং করণীয় গঠনমূলক আলোচনার মাধ্যমে সমাজে জারি রাখা। কোথায় আজ জাতির সম্ভাবনা আর ভবিষ্যৎ–মুখী আলোচনা? দূরদর্শী নেতৃত্ব, রাজনৈতিক সদিচ্ছা এবং সুষ্ঠু দিকনির্দেশনা থাকলে সংস্কারসহ সর্বজনীন ভোটের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক উত্তরণ খুব কঠিন কাজ নয়। বাস্তবে তো ১৯৭১-এর স্বাধীনতা এবং ১৯৯০-এর গণ-অভ্যুত্থানের পরও একটি কল্যাণকর রাষ্ট্র, গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ার সুযোগ চূড়ান্ত বিশ্লেষণে হাতছাড়াই করেছিলাম আমরা। বাংলাদেশকে উন্নয়নের ‘টেস্ট কেস’ গণ্য করা কিংবা ‘ওয়ান ইলেভেন’ নামক বিজাতীয় প্রকল্পও আমরা দেখেছি। কিন্তু তাতেও তো অতি উৎসাহী ‘জাতি ভাইরা’ সক্রিয় ছিলেন। বিভেদের রাজনীতিকে দায়ী করে বা ওই পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে বিদেশি প্রভুত্ব মেনে নেওয়া অগণতান্ত্রিক শাসনের পক্ষে সাফাইয়ের কমতি দেখিনি। ২০০১-এর সুষ্ঠু এবং তুলনামূলকভাবে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পরও দেখেছি ব্যর্থ রাষ্ট্রের আলোচনায় কিছু লোকের খুব উৎসাহ। তাত্তি¡কভাবে বললে ব্যর্থ রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্যের মধ্যে রয়েছে বিদ্রোহ প্রবণতা, রাজনৈতিক দুর্নীতি, অকার্যকর আমলাতন্ত্র ও বিচারব্যবস্থা, সামর্থ্যহীন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ইত্যাদি। এই লক্ষণগুলো কি তখনই বাড়েনি যখন শাসকগোষ্ঠী দেশের মানুষের অধিকারের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে? এখন অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সরকারকে ব্যর্থ প্রমাণ করতে মরিয়া লোকেরা বলতে চান ‘আগেই তো ভালো ছিলাম’। অন্য সবাই না হোক, এই ‘আগেই তো ভালো ছিলাম’ গোষ্ঠী হাসিনার আমলে যে অনেক সুবিধাজনক অবস্থায় ছিল, তা বুঝতে আমাদের কষ্ট হয় না। তাঁদের কথাবার্তা শুনে মনে হয়, আহ! কত ভালো ছিল ভোট ডাকাতি, জাতীয় সম্পদ লুণ্ঠন আর দেশ বিক্রির যুগ! না হলে পুরো রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে আসত কী করে? তাই রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাকে ‘রিসেট’ করার চেষ্টাকে কঠিন পাপের কাজ মনে করতেই পারে ফ্যাসিবাদের দোসরেরা। কারণ, ২০২৪-এর ঐতিহাসিক সুযোগে একটি গণতান্ত্রিক ও উন্নত বাংলাদেশের সূচনা হলে তাঁদের কি মুখ থাকে? আশার কথা, তাঁদের গায়ে জ্বালা ধরাটাই বলে দেয়, এবারের বিপ্লবের সুযোগ মোটেই হাতছাড়া হয়নি। তবে শুভশক্তির দায়িত্ব জন–আকাঙ্ক্ষা এবং করণীয় গঠনমূলক আলোচনার মাধ্যমে সমাজে জারি রাখা। যেমন আমরা প্রশ্ন করি, অফিস-আদালতের ঘুষের রাজত্বেই কি আমাদের বসবাস করতে হবে? দূষিত ও ন্যায়বিচারহীন পরিবেশেই কি আমাদের থাকতে হবে? নি¤œমানের শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা নিয়েই কি আমাদের সন্তুষ্ট থাকতে হবে এই হিংসা-বিদ্বেষের সমাজে? প্রবল অর্থনৈতিক ও শ্রেণিবৈষম্যের সমাজই কি আমাদের চিরন্তন নিয়তি হয়ে থাকবে? এসবের সমাধান চাওয়া ও পাওয়া তরুণ ও অনাগত ভবিষ্যৎ প্রজন্মেরও অধিকার। দেশের সব অংশীজন যদি আগামী দিনে সত্যিকারের পরিবর্তন আনার সিদ্ধান্ত নেয়, তাহলে তাদের কে ঠেকাতে পারবে?
খাজা মাঈন উদ্দিন সাংবাদিক।




Your email address will not be published.

Comments are closed.


আজকের পত্রিকা
আজকের পত্রিকা
ফেসবুকে আমরা
পুরনো সংখ্যা
সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি রবি
 
১০
১১১২১৩১৪১৫১৬১৭
১৮১৯২০২১২২২৩২৪
২৫২৬২৭২৮২৯৩০৩১
Copyright © Dundeebarta 2024
ডান্ডিবার্তা