আজ মঙ্গলবার | ২৯ জুলাই ২০২৫ | ১৪ শ্রাবণ ১৪৩২ | ৩ সফর ১৪৪৭ | রাত ৯:০৯

না’গঞ্জে চাঁদাবাজদের বিরুদ্ধে চিরুনী অভিযানে নামছে প্রশাসন

ডান্ডিবার্তা | ২৯ জুলাই, ২০২৫ | ৯:২৮ পূর্বাহ্ণ

ডান্ডিবার্তা রিপোর্ট
নারায়ণগঞ্জের শিল্পাঞ্চল জুড়ে চাঁদাবাজি, অবৈধ দখল ও সন্ত্রাসী কর্মকাÐে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছেন ব্যবসায়ীরা। গণঅভ্যুত্থানের পর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির শিথিলতার সুযোগে বিভিন্ন এলাকায় রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় গড়ে উঠেছে একাধিক চাঁদাবাজ চক্র। বিসিক, নিতাইগঞ্জ, নয়ামাটি, ফতুল্লা, রূপগঞ্জ, সোনারগাঁও, সিদ্ধিরগঞ্জসহ গুরুত্বপূর্ণ শিল্প ও বাণিজ্যিক এলাকায় চাঁদার দাবিতে হামলা, হুমকি ও দখলের ঘটনা বাড়ছে। পোশাক খাত, পরিবহন খাত, ফুটপাত, এমনকি সরকারি প্রকল্পেও সক্রিয় চাঁদাবাজরা। চাঁদাবাজদের মোকাবেলায় চাঁদাবাজি, অবৈধ দখল এবং ভয়ভীতি প্রদর্শনের অভিযোগে আলোচিত ব্যক্তিদের একটি তালিকা তৈরি করছে সংশ্লিষ্ট প্রশাসন ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো। বিভিন্ন এলাকার ব্যবসায়ী, পরিবহন মালিক-শ্রমিক সংগঠন, ঠিকাদার, নাগরিক সমাজ ও গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যের ভিত্তিতে অভিযোগ যাচাই করে এই তালিকা তৈরি করা হচ্ছে বলে একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে। স্থানীয় একাধিক ব্যবসায়ী বলেন, গণঅভ্যুত্থানের পর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নাজুক থাকায় এলাকায় এলাকায় ছোট-বড় চাঁদাবাজ গজিয়ে উঠেছে। তারা ছোট থেকে শুরু করে বড় ব্যবসায়ীদের চাঁদার জন্য নানা হুমকি-ধমকি দিচ্ছেন। রাজনৈতিক নেতাদের ছত্রছায়ায় চাঁদাবাজরা দিন-দিন বেপরোয়া হয়ে উঠছেন। এমনকি পোশাকখাতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখা গার্মেন্টস ব্যবসায়ীরাও রয়েছেন অস্বস্তিতে। কেবল চাঁদা নয় কারখানার ওয়েস্টিজ মালামাল (ঝুট) নিয়েও ঝামেলায় পড়তে হচ্ছে তাদের। প্রশাসনিক কঠোরতা না থাকায় এই ধরনের কর্মকাÐ থামানো যাচ্ছে না বলে অভিযোগ ব্যবসায়ীদের। এদিকে, খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নারায়ণগঞ্জ শহরের বিসিক, নিতাইগঞ্জ, নয়ামাটি হোসিয়ারি পল্লীসহ বেশ কয়েকটি বাণিজ্যিক এলাকায় এ চাঁদাবাজির মাত্রা অত্যাধিক বেশি। এছাড়া, শহরের ফুটপাত, হাট, মাঠ ও ঘাট দখলেও বেপরোয়া হয়ে উঠেছে রাজনৈতিক আশ্রয়ে বেড়ে ওঠা সন্ত্রাসী বাহিনী। পরিবহন খাতে প্রতিদিন লক্ষাধিক টাকা চাঁদা আদায় করা হচ্ছে। এমনকি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও সরকারি প্রকল্পেও চাঁদাবাজির নেটওয়ার্ক সক্রিয় রয়েছে। জেলার আড়াইহাজার, রূপগঞ্জ, সোনারগাঁও, ফতুল্লা ও সিদ্ধিরগঞ্জ অঞ্চলের ব্যবসায়ীরাও চাঁদাবাজিতে অতিষ্ঠ। স্থানীয়রা বলছেন, চাঁদাবাজি ও দখলদারির মাধ্যমে অনেকেই রাতারাতি আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়ে গেছেন। অপরাধমূলক কর্মকাÐ ঢাকতে অনেকেই রাজনৈতিক দলগুলোকে শেল্টার হিসেবে ব্যবহার করছেন। কেউ কেউ ৫ আগস্টের পর গাড়ি ও ফ্ল্যাট কিনেছেন বলেও তথ্য মিলছে। অথচ কয়েকমাস আগেও তাদের অর্থনৈতিক অবস্থা নাজুক ছিল। এদিকে, চাঁদাবাজি ও দখলদারিত্বের অভিযোগে ইতোমধ্যে বেশ কয়েকজন ব্যক্তি গ্রেপ্তার হয়েছেন। তাদের মধ্যে রাজনৈতিক পদধারী নেতারাও রয়েছেন। জানা যায়, গত ১৫ অক্টোবর রূপগঞ্জ উপজেলার গন্ধর্বপুর এলাকা থেকে গ্রেপ্তার হন হাফিজুর রহমান পিন্টু। তিনি তারাব পৌরসভা বিএনপির এ সাধারণ সম্পাদক। পুলিশ জানায়, তারাব পৌরসভার নোয়াগাঁও এলাকার নির্মাণাধীন আন্নি টেক্সটাইল মিলের মালিক আলী আহম্মদের কাছে হাফিজুর রহমান পিন্টুসহ তার সহযোগীরা বিশ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করে। চাঁদা না দেওয়ায় তার কারখানায় হামলা ও ভাঙচুর করা হয়। এমনকি মালিক আলী আহাম্মদকে মারধরও করা হয়। এ ঘটনায় থানায় মামলা করেন ওই শিল্প কারখানার মালিক। পরে যৌথ বাহিনীর অভিযানে গ্রেপ্তার হন বিএনপি নেতা পিন্টু। গত জানুয়ারি মাসে সোনারগাঁ উপজেলার জামপুর এলাকায় ব্যবসায়ী আনোয়ারের কাছে চাঁদা না পেয়ে প্রায় ১ কোটি টাকার ইট, সিমেন্ট ও রোড সহ নির্মাণ সামগ্রী লুট করে নিয়ে যাওয়ার অভিযোগে সোনারগাঁ উপজেলা যুবদলের সিনিয়র যুগ্ম আহবায়ক আশরাফ ভূইয়াকে বহিস্কার করে কেন্দ্র গত ২২ জুন গ্রেপ্তার হন সোনারগাঁ উপজেলার সাদিপুর ইউনিয়ন বিএনপির ৪ নম্বর ওয়ার্ডের সভাপতি শাহজাহান ভূঁইয়া। তার বিরুদ্ধে এক প্রবাসীর কাছ ৫ লাখ টাকা চাঁদা দাবির অভিযোগ উঠেছিল। চাঁদা না দিলে ওই প্রবাসীকে গুলি করে হত্যারও হুমকি দেন শাহজাহান ভূঁইয়া। একই উপজেলার বিএনপি নেতা আতাউর রহমানও বাস স্ট্যান্ডে চাঁদাবাজির অভিযোগে যৌথ বাহিনীর অভিযানে গ্রেপ্তার হন। আতাউর সোনারগাঁ উপজেলা বিএনপির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। গত ২৯ সেপ্টেম্বর উপজেলার হাবিবপুর গ্রাম থেকে আটক করা হয়। গত ২৯ জুন ১৫ লাখ টাকা চাঁদা না পেয়ে বন্দর উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান আতাউর রহমান মুকুলের উপর হামলার করার অভিযোগ উঠে সোনারগাঁ উপজেলা বিএনপির সহসভাপতি বজলুর রহমানের বিরুদ্ধে। এই ঘটনায় তার বিরুদ্ধে বন্দর থানায় মামলা করা হয়। এদিকে, সদর উপজেলার ফতুল্লায় চাঁদা না দিলে পোশাক কারখানা পুড়িয়ে ফেলার হুমকি দিয়ে গ্রেপ্তার হন ফতুল্লা থানা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক রিয়াদ মোহাম্মদ চৌধুরী। ক্লিন ইমেজধারী অনেক নেতা আড়ালে আবঢালে থেকে কতিপয় চাঁদাবাজদের দিয়ে নারায়ণগঞ্জের সর্বত্র বড় বড় ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে গত বছরের ৫ আগষ্টের পর থেকে এ পর্যন্ত কোটিপতি বনে গেছে। প্রশাসন একটু খেয়াল করলেই তাদের অতীত বর্তমান বিশ্লেষণ করে বুঝা যাবে তারা কত বড় চাঁদাবাজ। গত ১৫ মে ঢাকার বিমানবন্দর থেকে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে দল থেকে তাকে বহিষ্কার করে বিএনপি। এদিকে, চাঁদাবাজিতে অতিষ্ঠ হয়ে গত ২৪ মে শহরে লাঠি মিছিল করে হোসিয়ারি মালিকরা। বাংলাদেশ হোসিয়ারি অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি বদিউজ্জামান বদু, “আমরা চাঁদাবাজিতে অতিষ্ঠ হয়ে ব্যবসায়ীদের একত্রিত করে মিছিল করেছি। কিছু দুষ্কৃতকারী, চাঁদাবাজ মার্কেটে এসে মালিকদের কাছে জোর করে চাঁদা দাবি করে। আমরা আইনকে শ্রদ্ধা করি। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এই চাঁদাবাজদের বিরুদ্ধে দৃশ্যমান কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না।” তিনি আরও বলেন, “আমরা লাঠি মিছিল করে বুঝিয়ে দিলাম আমরাও চাঁদাবাজদের প্রতিহত করতে পারি। কিন্তু আমরা আইন হাতে তুলে নিলাম না। শুধু সন্ত্রাসীদের বুঝিয়ে দিলাম সন্ত্রাসী-চাঁদাবাজি করলে আমরা প্রতিহত করতে প্রস্তুত।” তবে, জেলা প্রশাসনের একটি সূত্র বলছে, সরকার এ বিষয়ে কঠোর অবস্থানে রয়েছে। প্রভাবশালী রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় থাকা চাঁদাবাজদের গতিবিধি নজরে রাখা হচ্ছে। কেউ রাজনৈতিক দলের পরিচয় ব্যবহার করে, কেউবা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নাম ভাঙিয়ে নিয়মিতভাবে চাঁদা আদায় করছে- এমন একাধিক অভিযোগ পেয়েছে প্রশাসন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জেলা পুলিশের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, “সরকারি উচ্চ মহল থেকে এ তালিকা করার নির্দেশনা এসেছে। বেশ কয়েকদিন ধরেই এ তালিকা তৈরির কাজ চলছে। তালিকাটি শুধু একটি নথি নয়, এটি ভবিষ্যতের শুদ্ধি অভিযানের ভিত্তি হয়ে উঠতে পারে। অতীতে যারা ধরাছোঁয়ার বাইরে ছিলেন, তারাও এবার অন্তর্ভুক্ত হচ্ছেন।” গত ২৬ জুলাই নারায়ণগঞ্জে র‌্যাব-১১ এর সদরদপ্তর পরিদর্শনে এসে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীও চাঁদাবাজদের বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেন। এমনকি রাজনৈতিক কোনো মহলের ‘তদবিরও’ এক্ষেত্রে আমলে না নেওয়ার জন্য সরাসরি নির্দেশনা দেন তিনি। তিনি বলেন, “বর্তমানে চাঁদাবাজের সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে। চাঁদাবাজদের বিরুদ্ধে ভালোভাবে কাজ করে যেতে হবে। কোনো বিশেষ ব্যক্তির রিকুয়েস্টে চাঁদাবাজকে ছাড় দেওয়া যাবে না। চাঁদাবাজ যতই শক্তিশালী হোক না কেন র‌্যাব কর্মকর্তা থেকে শক্তিশালী না। ধরে ফেলতে হবে।” তবে বিশ্লেষকরা মনে করছেন, তালিকা প্রণয়ন পদক্ষেপ হলেও তা যথাযথ প্রয়োগ না হলে এর কার্যকারিতা হারাবে। চাঁদাবাজদের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নিশ্চিত করাই মূল চ্যালেঞ্জ। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নিরপেক্ষভাবে সক্রিয় হয়ে রাজনৈতিক পরিচয় যাই হোক না কেন, সকল চাঁদাবাজের বিরুদ্ধে দৃশ্যমান ব্যবস্থা নিতে হবে এই প্রত্যাশাই এখন ভুক্তভোগী ব্যবসায়ী সমাজ ও সাধারণ মানুষের।




Your email address will not be published.

Comments are closed.


আজকের পত্রিকা
আজকের পত্রিকা
ফেসবুকে আমরা
পুরনো সংখ্যা
সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি রবি
 
১০১১১২১৩
১৪১৫১৬১৭১৮১৯২০
২১২২২৩২৪২৫২৬২৭
২৮২৯৩০৩১  
Copyright © Dundeebarta 2024
ডান্ডিবার্তা