বাসের হেলপার যেভাবে কোটিপতি
ডান্ডিবার্তা রিপোর্ট নারায়ণগঞ্জ শহর ও শহরতলীর আশপাশ এলাকার এক আলোচিত নাম শাহিন ওরফে বরিশাইল্লা শাহিন ওরফে ডন শাহিন। তিনি রাজনৈতিক কোন নেতা বা শির্ষ পর্যায়ের কোন সন্ত্রাসী ও নয়। তিনি হলেন বর্তমান সময়ের শহর ও শহরতলীর আশপাশ এলাকার সবচাইতে শির্ষ স্থানীয় মাদক ব্যবসায়ী। পুলিশ পিটিয়েও গ্রেপ্তার না হয়ে দিব্বি মাদক ব্যবসা করে এই নারায়নগঞ্জ শহরেই সে বসবাস করছে। বাসের হেলপার থেকে মাদক ব্যবসা করে কোটিপতি বনে যাওয়া এই মাদক ব্যবসায়ী আইন- শৃংখলা বাহিনীকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে স্বীয় স্টাইলে প্রকাশ্যে চানমারী, চাষাড়া নতুন রাস্তা থেকে তল্লা রেল লাইন পর্যন্ত, খানপুর, সবুজবাগ, মাউড়াপট্টিসহ আশপাশ এলাকাজুড়ে প্রকাশ্যে লোক দিয়ে বিক্রি করাচ্ছে মাদক। আর এই মাদকের টাকা দিয়েই ফতুল্লা ধর্মগঞ্জ চটলার মাঠ এলাকায় ১০ তলা ফান্ডেশনের ৩ তলা কমপ্লিট বাড়ি করেছে। এছাড়াও বন্দরের বিভিন্ন এলাকায় শাহিন এবং তার পিতা মাতার নামে বাড়ি রয়েছে। তার বৈধ কোন ব্যবসা বানিজ্য না থাকলেও তিনি কয়েক কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন। শাহিনের মাদকের স্পটে প্রশাসন হানা দিয়ে কাউকে গ্রেপ্তার করলে বা গ্রেপ্তার অভিযান পরিচালনা করলে প্রশাসন কে ম্যানেজ করতে প্রেস লেখা স্টিকার লাগানো মটর বাইক হাকিয়ে ছুটে যায় বিশেষ পেশার পরিচয় দানকারী একাধিক জন। শাহিন সম্পর্কে জানা যায়, এক দশক পূর্বে ও ছিলেন বাস চালকের সহকারী (হেলপার)। বরিশাল থেকে নারায়ণগঞ্জের তল্লা এলাকায় এসে পরিবার নিয়ে টিনের ঘরে ভাড়া থাকতেন। রাজমিস্ত্রি বাবার একার আয়ের সংসারে অভাব অনটন লেগেই থাকতো। সংসারে স্বচ্ছলতা আনতে বাসের হেলপারের কাজ ছেড়ে কিছুটা বেশি বেতনে কাজ নেন একটি প্রিন্টিং কারখানায়। কিন্তু তাতেও অভাব দূর হচ্ছিল না। এমন পরিস্থিতিতে এলাকার কয়েকজন যুবককে নিয়ে গড়ে তোলেন নিজস্ব বাহিনী। তল্লা এলাকার মাদক কারবারি সরোয়ারকে বিতাড়িত করে পুরো এলাকার মাদক কারবারের নিয়ন্ত্রণ নেন। ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় নেতাদের সঙ্গে সখ্য গড়ে বানিয়ে ফেলেন মাদকের বিশাল সিন্ডিকেট। প্রথম দিকে সীমান্ত এলাকা থেকে নিজেই বিভিন্ন যানবাহনে করে মাদক বহন করে আনতেন। এখন অবশ্য কয়েকশ সদস্যের সিন্ডিকেট দিয়ে মাদক এনে কারবার চালান। প্রকৃত নাম শাহীন মিয়া হলেও মাদকের ছোঁয়ায় রাতারাতি ধনী বনে যাওয়া এই ব্যক্তি এখন নারায়ণগঞ্জবাসীর কাছে পরিচিত বরিশাইল্লা শাহীন ওরফে ডন শাহীন নামে। শাহীনের উত্থান যেন সিনেমার গল্পের মতো। একসময়ের হতদরিদ্র এই যুবকের জুতা পর্যন্ত এখন অন্য কেউ পরিয়ে দেয়। দিনে এলাকার বিভিন্ন মসজিদ-মাদ্রাসায় টাকাপয়সা দান করে দানবীর সেজে থাকেন। আর রাতে বিশাল সিন্ডিকেটের মাধ্যমে শহরের সবচেয়ে বড় মাদক স্পট পরিচালনা করেন। ওয়ান ইলেভেনে জরুরি অবস্থা জারির আগে নারায়ণগঞ্জ শহরের চানমারী রেললাইন থেকে শুরু করে আজমেরীবাগ ও তল্লা জেমস ক্লাব পর্যন্ত আধিপত্য বিস্তার করে হেরোইনের কারবার করতেন সরোয়ার নামে এক ব্যক্তি। তাকে সরিয়ে দিয়ে গত ১০ বছর ধরে ওই এলাকাগুলোতে মাদকের একচেটিয়া কারবার চালাচ্ছেন বরিশাইল্লা শাহীন। এই এক দশকে তিনি মাদকের ডন হিসেবে পরিচিতি পেয়েছেন। মাদকের কারবারে জড়িয়ে মাত্র কয়েক বছরে কোটিপতি বনে গেছেন বহুল আলোচিত এই শাহীন। একসময় টিনের ঘরে ভাড়া থাকা এই শাহীনের এখন নারায়ণগঞ্জ শহরেই রয়েছে ছয়-সাতটি বাড়ি। বিপুল পরিমাণ মাদকসহ বেশ কয়েকবার গ্রেপ্তার হয়েছেন পুলিশের হাতে। তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন থানায় রয়েছে মাদকের আটটি মামলা। সম্প্রতি মাদকের মামলায় গ্রেপ্তার করতে যাওয়া পুলিশ সদস্যদের ওপর হামলা চালিয়ে ফের নতুন করে আলোচনায় এসেছেন এই বরিশাইল্লা শাহীন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ব্যক্তি জানায়, গত বছর শহরের বড় মাদক স্পট চানমারী বস্তি উচ্ছেদের পর তল্লা রেললাইন লাগোয়া বিশাল এলাকায় শাহীনের মাদক কারবার আরও জমজমাট হয়ে উঠেছে। তার অত্যাচারে জিম্মি হয়ে আছে এলাকাবাসী। তার নিয়ন্ত্রণে ফতুল্লা রেললাইন থেকে শুরু করে তল্লা হাজীগঞ্জ পর্যন্ত মাদক কারবার চলে। সম্প্রতি জেলার পুলিশ সুপারের নির্দেশে মাদকের হাট হিসেবে পরিচিত চানমারী বস্তি উচ্ছেদের পর তার সিন্ডিকেটের মাদক বিক্রি বেড়ে যায়। শাহীনের আক্রোশের শিকার হতে পারেন ভয়ে তার বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে মুখ খুলতে চান না কেউ। অল্প সময়ে তার উত্থানের বর্ণনা দিতে গিয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক নগরীর এক বাসিন্দা জানান, ২০০৯ সালে শাহীন ও তার পরিবারের সদস্যরা তল্লা পোড়া মসজিদের পেছনে একটি টিনের ঘরে ভাড়া থাকত। তখন তার বাবা রাজমিস্ত্রির আর শাহীন বাসের হেলপার হিসেবে কাজ করত। পরে একটি গার্মেন্টস কারাখানার প্রিন্টিং সেকশনে ১০ হাজার টাকার বেশি বেতনে চাকরি নেয় শাহীন। এই অল্প টাকার রোজগারে তাদের পরিবার তেমন একটা ভালোভাবে চলত না। বেশি টাকা উপার্জনের জন্য একপর্যায়ে সরোয়ারকে সরিয়ে মাদকের ডন শাহীন এলাকায় আধিপত্য বিস্তার করে। পর্যায়ক্রমে মাদক ব্যবসা করে রাতারাতি হয়ে ওঠে বৃহত্তর তল্লা এলাকার মাদকসম্রাট। মাদক কারবারের টাকায় শাহীন নগরীর ফতুল্লা ও বন্দর এলাকায় ছয়টি বাড়ি করেছে জানিয়ে ওই ব্যক্তি আরও বলেন, ‘ফতুল্লা চটলার মাঠ এলাকায় ১০ তলা ফাউন্ডেশনের ৩ তলা কমপ্লিট বাড়ি রয়েছে তার। এছাড়াও বন্দরের বিভিন্ন এলাকায় শাহীন ও তার বাবা-মার নামে বাড়ি রয়েছে। অন্য কোনো ব্যবসা-বাণিজ্য না থাকলেও সে কোটি টাকার মালিক হয়ে যায় এই ১০ বছরে। তার নিয়ন্ত্রনে এখন কয়েকশ যুবক চলে। এমনকি এই শাহিনের জুতা পর্যন্ত আরেকজনে পরিয়ে দেয়। যা অনেক সিনেমার গল্পকেও হার মানায়। ১৩ ফেব্রুয়ারি রাতে তল্লা এলাকায় অভিযানে গেলে পুলিশের ওপর হামলা চালায় শাহীন ও তার বাহিনীর সদস্যরা। এ ঘটনায় ১২ জন গ্রেপ্তার হয়। তবে কিছুদিন আতœগোপনে থাকার পর সেই মামলায় আদালত থেকে জামিন নেয়। মাদক কারবারি শাহীনের ঘনিষ্ঠ একজন নাম প্রকাশ না করার শতে জানান, পুলিশের ওপর হামলার ঘটনার পর তড়িঘড়ি করে ১৮ জন সহযোগীকে নিয়ে কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে পিকনিক করতে যান শাহিন। পুলিশ পেটানোর মামলায় গ্রেপ্তারের হাত থেকে বাঁচতে তিনি কিছুদিন আতœগোপনে চলে যান। অপরদিকে সে সময় পুলিশের ওপর হামলার ঘটনায় গ্রেপ্তার হওয়া শাহীনের সহযোগীদের ছাড়ানোর জন্য তার ক্যাশিয়ার কবির হোসেন বাবু দৌড়ঝাঁপ করছে বলে জানিয়েছেন এলাকাবাসী। ‘মাদকসম্রাট’ শাহীনের সেকেন্ড ইন কমান্ড হিসেবে আছে শাহ আলম নামে এক ব্যক্তি। শাহীনের নিজস্ব টর্চার সেলও রয়েছে। কেউ তার কথার অবাধ্য হলে তাকে ধরে নিয়ে সেই টর্চার সেলে মারধর করা হয়। জেলা পুলিশের তথ্যমতে, শাহীনের বিরুদ্ধে মাদকের আটটি মামলা রয়েছে। এর মধ্যে ফতুল্লা মডেল থানায় ছয় এবং সদর মডেল থানায় রয়েছে দুটি। গত বছর ১২ মার্চ ফতুল্লার সবুজবাগ এলাকায় অভিযান চালিয়ে ১ লাখ ২৩ হাজার ইয়াবাসহ শাহীন এবং তার সহযোগী শাহ আলম, আল-আমিন, নাছির ও আলমগীরকে গ্রেপ্তার করেছিল পুলিশ।