আজ শুক্রবার | ১৫ আগস্ট ২০২৫ | ৩১ শ্রাবণ ১৪৩২ | ২০ সফর ১৪৪৭ | সকাল ৭:২৭

ডন বজলুর মাদক সাম্রাজ্য যাদের নিয়ন্ত্রণে

ডান্ডিবার্তা | ০৪ এপ্রিল, ২০২৩ | ১১:৪৮ পূর্বাহ্ণ

ডান্ডিবার্তা রিপোর্ট রূপগঞ্জ চনপাড়া এলাকার বহুল আলোচিত মাদক ব্যবসায়ী এবং কায়েতপাড়া ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের মেম্বার বজলুর রহমানের মৃত্যুর পর ওই এলাকা এখন থমথমে। চনপাড়া বস্তি এলাকা একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ করেছেন বজলু। সেখানে বিশাল ‘মাদকের সাম্রাজ্য’ গড়ে তুলেছিলেন তিনি। কিছুদিন আগে বজলুর অনুসারী রাশেদুল ইসলাম শাহীন ওরফে সিটি শাহীন র‌্যাবের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে মারা যান। অপর অনুসারী রাজু আহমেদ ওরফে রাজাকে গ্রেফতার করে র‌্যাব। এরপর বজলু অনুসারীরা সবাই এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যান। এই সুযোগে বজলু প্রতিদ্বন্দ্বীরা তার ‘মাদক সাম্রাজ্য’ দখলে নিয়েছে বলে জানা গেছে। স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, কয়েক বছর আগে বজলু মেম্বারের প্রভাবের ফলে চনপাড়া বস্তি ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন প্রতিদ্বন্দ্বী শমসের ও শাহাবুদ্দিন। এখন দুজনই এলাকায় ফিরে এসেছেন। বজলু রূপগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য পদে ছিলেন। তিনি প্রভাবশালী মহলের ছত্রচ্ছায়ায় থেকে প্রতিপক্ষকে দমন করে এলাকায় আধিপত্য বিস্তার করেন। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বজলুর রহমান চনপাড়া এলাকার ৬ নম্বর ওয়ার্ড এলাকার নাদের বক্সের ছেলে। তার গ্রামের বাড়ি বরিশালের হিজলা উপজেলার দুর্গম চরাঞ্চলের দুর্গাপুরে। শিশু বয়সে তার পরিবারের সদস্যরা চনপাড়া বস্তিতে চলে আসেন। একটু বড় হয়ে চালের ব্যবসা শুরু করেন বজলু। পরবর্তী সময়ে মাদক কারবার, চুরি, ছিনতাই, হত্যা, চাঁদাবাজি, প্লট জবরদখলসহ নানা অপরাধমূলক কর্মকা-ে জড়িয়ে পড়েন। তার বিরুদ্ধে হত্যা মামলাও রয়েছে। ২০০৪ সালে মাদক কারবারি এবং ভাড়াটে সন্ত্রাসী হিসেবে কাজ করে চনপাড়া এলাকায় আলোচনায় উঠে আসেন বজলু। পরে রাজনীতিতে যোগ দেন। রাজনৈতিক শেল্টার পেয়ে দুই বার কায়েতপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের মেম্বার নির্বাচিত হয়েছেন। এরপর থেকে তাকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। তার আত্মীয়-স্বজন ও পরিচিতদের মাদক ব্যবসাসহ নানা অপরাধমূলক কাজে ব্যবহার করে মাদকের বিশাল সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছিলেন। এদিকে, গত বছরের ৭ নভেম্বর নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যা নদীতে ভেসে ওঠে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র ফারদিন নূর পরশের লাশ। ফারদিনের মৃত্যুর ঘটনায় চনপাড়া বস্তির মাদক প্রসঙ্গ আলোচনায় আসে। সে সময় আলোচনায় আসে বজলু মেম্বারের নাম। ওই বছরের ১৮ নভেম্বর বিকালে র‌্যাব-১ চনপাড়ার পূর্বগ্রাম এলাকায় অভিযান চালিয়ে বজলুকে গ্রেফতার করে। ওই রাতেই র‌্যাব তার বিরুদ্ধে অস্ত্র, মাদক ও জাল টাকা রাখার অভিযোগে তিনটি মামলা করে। এই তিনটি মামলাসহ বজলুর বিরুদ্ধে হত্যা ও মাদকসহ কমপক্ষে ২৩টি মামলা ছিল বলে র‌্যাব সে সময় জানিয়েছিল। পরে তাকে কারাগারে পাঠানো হয়। গত ২৩ মার্চ কারাগারে অসুস্থ হয়ে পড়লে বজলুকে নারায়ণগঞ্জ জেনারেল (ভিক্টোরিয়া) হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখান থেকে ওইদিনই ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে পাঠানো হয়। চিকিৎসাধীন অবস্থায় গত ৩১ মার্চ সন্ধ্যায় ঢামেক হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) মারা যান তিনি। অনুসন্ধানে জানা যায়, ফারদিন নূর পরশ ইস্যুকে কেন্দ্র করে গত ১১ নভেম্বর র‌্যাবের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে রাশেদুল ইসলাম শাহীন ওরফে সিটি শাহীন মারা যান এবং রাজু আহমেদ ওরফে রাজা র‌্যাবের হাতে গ্রেফতার হন। তারা দুজনই বজলু মেম্বারের অনুসারী। তাদের অনুপস্থিতিতে সিটি শাহীন বাহিনীর প্রধান ও তাদের সহযোগী ফাহাদ আহমেদ ওরফে শাওন, স্বপন ব্যাপারী এবং রায়হান গং এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যায়। তারা বজলু ও সিটি শাহীনের ঘনিষ্ঠজন হিসেবে এলাকায় পরিচিত। স্থানীয়রা বলছেন, বজলু ও তার বাহিনীর অনুপস্থিতিতে চনপাড়া বস্তির মাদকসহ অপরাধ সাম্রাজ্যের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিয়েছে প্রতিদ্বন্দ্বী শমসের ও শাহাবুদ্দিন বাহিনী। একে একে চনপাড়া বস্তিতে ফিরতে শুরু করেছেন বজলু মেম্বারের প্রতিদ্বন্দ্বীরা। শমসের ও শাহাবুদ্দিনের পরে জয়নাল নামে আরেক মাদক কারবারি ফিরে এসেছেন। বজলু মেম্বারের সঙ্গে বিরোধের কারণে তারা চনপাড়া এলাকার বাইরে ছিলেন। এখন শমসের ও শাহাবুদ্দিনের নেতৃত্বে চনপাড়া বস্তিতে কমপক্ষে ৪০টির বেশি স্পটে মাদক বিক্রি হচ্ছে বলে স্থানীয় একাধিক সূত্র জানিয়েছে। এতে প্রতিদিন চনপাড়ায় লাখ লাখ টাকার মাদক বেচাকেনা হচ্ছে। আর সেই টাকার মোটা অংকের ভাগ পাচ্ছেন প্রভাবশালী মহলের মদতদাতারা। স্থানীয়রা আরও বলছেন, বজলু মেম্বারের গ্রেফতার ও মৃতুতে মাদক ব্যবসা ও বিক্রি বন্ধ হয়নি। শুধু মাদক ব্যবসার নিয়ন্ত্রক পরিবর্তিত হয়েছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রূপগঞ্জ থানা ছাত্রলীগের শীর্ষ পদে থাকা এক নেতা জানান, চনপাড়া এলাকায় কেউ বেশিদিন টিকতে পারে না। খুন ও হামলা-মামলার ঘটনার মধ্য দিয়ে এই চনপাড়া এলাকার নিয়ন্ত্রকের ধারাবাহিক পরিবর্তন হয়েছে। বজলু মেম্বার মারা যাওয়ার পর চনপাড়া এলাকার মাদক সম্রাজ্যের নিয়ন্ত্রকের চেয়ারে বসেছেন শমসের ও শাহাবুদ্দিন। তাদের বিরুদ্ধে মাদক ও হত্যাসহ অসংখ্য মামলা রয়েছে। স্থানীয় ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের প্রশ্রয়ে এই এলাকার মাদকের নিয়ন্ত্রণ তারা নিয়ে নিয়েছে। আর প্রশ্রয়দাতারা দিন শেষে মাদকের টাকার একটা ভাগ পেয়ে যায়। এভাবেই চলছে চনপাড়া বস্তির মাদক কারবার ও অপরাধের সাম্রাজ্য। স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, ২০১৯ সাল পর্যন্ত চনপাড়ার মাদকসহ বিভিন্ন অপরাধের নিয়ন্ত্রক ছিলেন দুজন। একজন কায়েতপাড়া ইউপি সদস্য বজলু রহমান এবং অন্যজন কায়েতপাড়া ইউপির তৎকালীন সংরক্ষিত নারী সদস্য বিউটি আক্তার ওরফে কুট্টি। আধিপত্য বিস্তারের দ্বন্দ্বে ২০১৭ সালের নভেম্বর মাসে নারী সদস্য বিউটি আক্তারের স্বামী এমএ হাসানকে হত্যা করা হয়। এবং ২০১৯ সালের জুনে বিউটি আক্তার খুন হলে বদলে যায় পরিস্থিতি। চনপাড়ার একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ চলে আসে বজলুর কাছে। তিনি গড়ে তোলেন মাদক ও অপরাধের বিশাল সাম্রাজ্য। আর মামলা-হামলা থেকে রক্ষা পেতে ক্ষমতাসীন দলের রাজনীতিতে প্রবেশ করেন। ক্ষমতাসীন দলের বিভিন্ন রাজনীতিকদের সঙ্গে ছবি তুলে এবং ব্যানার ফেস্টুন সাঁটিয়ে ধরাকে সরা জ্ঞান করে চলতেন। যে কারণে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর হামলা করার সাহস দেখিয়েছেন এই বজলু রহমান। সেই ঘটনায় তার বিরুদ্ধে মামলাও হয়েছে। র‌্যাবের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে মারা যাওয়া বজলু মেম্বারের অনুসারী রাশেদুল ইসলাম শাহীন ওরফে সিটি শাহীনের স্ত্রী রোকেয়া আক্তার ইতি বলেন, ‘চনপাড়া এলাকার মাদকের বিশাল সাম্রাজ্যের নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতে নিতে শমসের ও শাহাবুদ্দিন র‌্যাব দিয়ে প্রথমে আমার স্বামীকে ( শাহীন) গুলি করে মেরেছে। পরে বজলু মেম্বারকে তুলে নিয়ে গেছে, এখন সেও (বজলু) মারা গেছে। এখন পুরো রাজত্ব তাদের (শমসের ও শাহাবুদ্দিন) নিয়ন্ত্রণে। চনপাড়া এলাকার নয়টি ওয়ার্ডে তাদের প্রায় ৪০টির অধিক মাদকের স্পট রয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে কথা বলার আর কেউ থাকলো না। আর পেছন থেকে ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালী নেতারা তাদের শেল্টার দিচ্ছেন। এ ছাড়াও একজন নারী জনপ্রতিনিধি এই মাদকের টাকার ভাগ পেয়ে বিশাল সম্পদের মালিক বনে গেছেন। এভাবে আরও অনেকে এই টাকার ভাগ পেয়ে তাদের শেল্টার দিচ্ছেন। অপরদিকে শমসের ও শাহাবুদ্দিনের লোকজন রমরমা মাদকের ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। এ বিষয়ে কেউ প্রতিবাদ করলে উল্টো তাকে মিথ্যা মামলা দিয়ে ফাঁসিয়ে দেওয়ার হুমকি দেওয়া হয়। এ কারণে ভয়ে কেউ ওদের বিরুদ্ধে মুখ খোলে না।’ চনপাড়া শেখ রাসেল নগর ইউনিয়ন স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি এস এম শফিকুল ইসলাম জাহিদ বলেন, ‘বজলু মেম্বার চনপাড়া এলাকার ডন ছিলেন। তার সময়ে প্রকাশ্যে মাদক বিক্রি হতো। এখন সেটা কমে এসেছে। তবে মাদকের মোটা অংকের টাকার হাতছানিতে এখনও মাদক ব্যবসা চলছে। এটা রাতারাতি নির্মূল করা সম্ভব নয়। তা ছাড়া আরেকটি চক্র এই মাদক ব্যবসায় সক্রিয় হয়ে উঠেছে। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। প্রশাসনের লোকজন আমাকে সহায়তা করলে এসব বন্ধে কাজ করতে চাই।’ চনপাড়া এলাকায় বর্তমানে শমসের ও শাহাবুদ্দিনের নেতৃত্বে মাদক বিক্রি হচ্ছে কিনা– এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আপনি যেটি শুনেছেন তা সত্য। নানান চাপের কারণে আমরা অনেক কিছু বলতে পারি না।’ এই বিষয়ে মন্তব্য নেওয়ার জন্য শমসের ও শাহাবুদ্দিনের সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। এসব বিষয়ে জানতে চাইলে নারায়ণগঞ্জের সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার আবির হোসেন বলেন, ‘বজলু মেম্বারের বিরুদ্ধে হত্যা, মাদকসহ অনেক মামলা রয়েছে। সর্বশেষ র‌্যাব তার বিরুদ্ধে তিনটি মামলা করেছে। তার অবর্তমানে চনপাড়া এলাকায় মাদকের ব্যবসা কমেছে। তবে মাদক ব্যবসা একেবারে বন্ধ হয়নি। এটি নির্মূল করতে সময় লাগবে।’ চনপাড়ায় বজলুর সাম্রাজ্য শমসের ও শাহাবুদ্দিন এখন নিয়ন্ত্রণ করছে কিনা, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘শমসেরের বিরুদ্ধে অনেক মামলা রয়েছে। তারা মূলত বজলু মেম্বারের প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন। এখন বজলু সেখানে না থাকার ফলে তারা হয়তো সক্রিয় হয়ে উঠেছে। তবে বজলু মেম্বারের মতো কেউ প্রকাশ্যে মাদক ব্যবসাসহ পুরো এলাকা নিয়ন্ত্রণ করার মতো স্পর্ধা দেখাতে পারেনি। এরপরও তারা যদি বজলু মেম্বারের মাদকের ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করে থাকে, তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’




Your email address will not be published.

Comments are closed.


আজকের পত্রিকা
আজকের পত্রিকা
ফেসবুকে আমরা
পুরনো সংখ্যা
সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি রবি
 
১০
১১১২১৩১৪১৫১৬১৭
১৮১৯২০২১২২২৩২৪
২৫২৬২৭২৮২৯৩০৩১
Copyright © Dundeebarta 2024
ডান্ডিবার্তা