আজ শুক্রবার | ১৫ আগস্ট ২০২৫ | ৩১ শ্রাবণ ১৪৩২ | ২০ সফর ১৪৪৭ | রাত ১২:২৩

ফায়ার ম্যান জাহাঙ্গীরের স্বপ্ন পূরণ হলো না

ডান্ডিবার্তা | ২৭ জুলাই, ২০২৩ | ১১:২০ পূর্বাহ্ণ

ডান্ডিবার্তা ডিরপোর্ট বাবার চাওয়া ছিল মেয়ে বিসিএস ক্যাডার হবে, সেভাবেই নিজের পড়াশোনা এগিয়ে নিচ্ছিল চাঁদনী। সামনের এইচএসসি পরীক্ষার প্রস্তুতি নিয়ে এখন তার ব্যস্ত থাকার কথা। কিন্তু বাবাকেই হারিয়ে চাঁদনী এখন শোকে দিশেহারা। ইসরাত জাহান চাঁদনী (১৭) ফায়ার সার্ভিসের গাড়িচালক জাহাঙ্গীর হোসেনের বড় মেয়ে এবং চাঁদপুরের হাজীগঞ্জ মডেল সরকারি কলেজের মানবিক বিভাগের দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী। চাঁদনীর বাবা জাহাঙ্গীর হোসেন গত সোমবার সকাল ১১টার দিকে রপ্তানিমুখী একটি পোশাক কারখানার আগুন নেভাতে যাওয়ার পথে নারায়ণগঞ্জের চাষাঢ়ায় এক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন। ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা বলছেন, চালক জাহাঙ্গীর হোসেন হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লে গাড়িটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে রাস্তায় কয়েকটি যানবাহনে ধাক্কা দেয়। এ দুর্ঘটনায় জাহাঙ্গীরসহ চারজন মারা যান, আহত হন আরও পাঁচজন। ১৯৯৭ সালে ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সে যোগ দেওয়া জাহাঙ্গীর নারায়ণগঞ্জ শহরের হাজীগঞ্জ ফায়ার স্টেশনের গাড়িচালক ছিলেন। ২০২২ সালের জানুয়ারিতে এই স্টেশনে যোগদান করেন তিনি। এর আগে চাঁদপুরের হাজীগঞ্জ স্টেশনে কর্মরত ছিলেন। তিনি নারায়ণগঞ্জে বদলি হলেও পরিবার থেকে যায় চাঁদপুরেই। জাহাঙ্গীরের তিন সন্তানের মধ্যে বড় চাঁদনী। ফায়ার সার্ভিসে নি¤œ পদে চাকরি করলেও চাঁদনীকে প্রথম শ্রেণির বিসিএস কর্মকর্তা হিসেবে দেখার স্বপ্ন ছিল তার। বাবার সেই স্বপ্ন লালন করতেন মেয়েও।মঙ্গলবার সন্ধ্যায় মোবাইল ফোনে কথা হয় চাঁদনীর সঙ্গে। বাবার প্রসঙ্গ উঠতেই ঢুকরে কেঁদে ওঠেন তিনি। কাঁদতে কাঁদতেই বলেন, “১৭ তারিখ (অগাস্ট) আমার এইচএসসি পরীক্ষা। কীভাবে পরীক্ষা দিমু আমি জানি না। আমাকে অনেক দূর পর্যন্ত পড়ানোর ইচ্ছা ছিল আব্বুর। তিনি আমারে বিসিএস ক্যাডার হিসেবে দেখতে চাইতেন। আমিও সেইভাবেই আগাচ্ছিলাম। “কিন্তু এখন কীভাবে কী করবো কিছুই বুঝে আসছে না। ছোট ভাইটা তো কাল থেকে অনবরত কান্না করতেছে।’ বাবার সাথে সর্বশেষ তিনদিন আগে ফোনে কথা হয় বলে জানান চাঁদনী। তখনও বাবা পরীক্ষার প্রস্তুতি কেমন জানতে চেয়েছিলেন। শীঘ্রই ছুটিতে ফিরবেন বলেও জানান। এক সপ্তাহ পরিবারের সাথে ছুটি কাটিয়ে ১২ জুলাই কর্মস্থলে যোগ দিয়েছিলেন জাহাঙ্গীর হোসেন। কয়েকদিন পর আবার ছুটিতে বাড়ি ফেরার কথা ছিল তার। জাহাঙ্গীরের স্ত্রী রেখা আক্তার জানান, গত সোমবার সকাল ১০টার পর ভিডিও কলে স্বামীর সঙ্গে কথা হয়েছিল। তখন বুকে ব্যথা হচ্ছে বলেও জানান তিনি। দু-তিনদিনের মধ্যে ছুটিতে ফিরলে হৃদরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে যাওয়ার কথাও বলেছিলেন। রেখা বলেন, “ভিডিও কলে কথা বলার সময় উনি রাতেও ডিউটি করেছেন বলে জানান। সকালে ভালো ঘুম হয়নি, বুকে খানিকটা ব্যথা করছিল। তারে বলছিলাম, ছুটিতে ফিরলে একত্রে ডাক্তারের কাছে যাবো। এরপর কারেন্ট চলি গেলে কল কাইটা যায়। “আধঘণ্টা পর স্টেশন থেকে কয়েকজন এসে জানান- উনি স্ট্রোক করেছেন। তখনও জানতাম না উনি মারা গেছেন। হাসপাতালে গিয়ে জানতে পারি।” এই বলেই কাঁদতে থাকেন রেখা। নিজেকে কিছুটা সংবরণ করে তারপর বলেন, “খুবই শান্ত প্রকৃতির মানুষ ছিল আমার স্বামী। ছেলে-মেয়েদের খোঁজখবর সবসময় রাখতেন। আমার সঙ্গে ছোট ছোট করে (নিচু স্বরে) কথা বলতেন। আমার চান্দের মতোন স্বামী… তারে আমি হারাইলাম। জাহাঙ্গীরের মেঝ মেয়ে নাদিয়া জাহান রাত্রি (১৩) চাঁদপুরের স্থানীয় একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে সপ্তম শ্রেণিতে পড়েন এবং ছোট ছেলে ইয়াসিন আরাফাত (৬) মাদরাসায় দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ে। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে অনিশ্চয়তায় রেখা আক্তার। তিনি বলেন, “চাঁদপুরে ভাড়া বাসায় থাকি। উনিই ছিলেন সব, উনি এখন নাই, সন্তানদের নিয়া আমি কীভাবে বাঁচবো!” নারায়ণগঞ্জ ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের উপ-সহকারী পরিচালক ফখর উদ্দিন আহম্মাদ জানান, গত সোমবার রাতে ময়নাতদন্তের পর জাহাঙ্গীরের মরদেহ চাঁদপুরে নিয়ে যান পরিবারের লোকজন। সেখানে তাকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় গার্ড অব অনার দেওয়া হয়। রাতে সেখানেই তার দাফন হয়। জাহাঙ্গীরের ভাগিনা শাহ্ মো. শোয়েব বলেন, “মামা গত তিন-চার বছর যাবৎ হার্টের সমস্যায় ভুগছিলেন। তাকে চিকিৎসার জন্য একবার ইন্ডিয়াতেও নেওয়া হয়। নিয়মিত ফলো-আপেও ছিলেন। ওষুধ খেতেন। তবে ফায়ারের কর্মী, তিনি ছিলেন খুব এনার্জেটিক। শারীরিক বিষয়টারে হয়তো তেমন গুরুত্ব দেননি। “শুনেছি আগের রাতেও তার ডিউটি ছিল। সকালে ঠিকমতো ঘুমাতে পারেননি। বিশ্রামের দরকার ছিল তার। কিন্তু আগুনের খবরে আবারও ছুটতে হয় তাকে। আর ঘটনার দিন যে পরিমাণ রোদের তাপমাত্রা ছিল তাতেই কাবু হয়ে যান। তবে নারায়ণগঞ্জ ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তা ফখর উদ্দিন আহম্মাদ বলেন, “জাহাঙ্গীরের হৃদরোগজনিত সমস্যার কথা অফিসিয়াল রেকর্ডে নেই। ঘটনার দিনও তার অসুস্থতাবোধ হচ্ছে এমনটা জানাননি। তেমনটা হলে পাশেই বিশেষায়িত হাসপাতাল ছিল, চেকআপ করানো যেত মুহূর্তেই। সেক্ষেত্রে অপারেশনে তাকে পাঠানো হতো না। এদিকে সরকারিভাবে সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা যা প্রাপ্য তা জাহাঙ্গীরের পরিবারকে দেওয়া হবে বলে জানান ফখর উদ্দিন। গত সোমবার ঘটনার সময় চালকের পাশের আসনে ছিলেন হাজীগঞ্জ ফায়ার স্টেশনের সিনিয়র স্টেশন অফিসার ওবায়দুল ইসলাম। তিনি বলেন, সাড়ে ১০টার দিকে আগুনের খবর পেয়ে স্টেশন থেকে গাড়ি বের হয়। চাষাঢ়ায় ট্র্যাফিক বক্সের সামনের সড়কে গাড়ি চলমান অবস্থায় হঠাৎ ঢলে পড়েন চালক জাহাঙ্গীর। এরপরই গাড়িটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে কয়েকটি যানবাহনে ধাক্কা দেয়। “গাড়ি চালানো অবস্থাতেই চালক স্ট্রোক করেছেন বলে ধারণা করছি। ঘটনা এতটাই দ্রুত ঘটেছে যে আমি গিয়ে স্টিয়ারিং ধরব বা কিছু করব তার সুযোগ ছিল না।”, যোগ করেন ফায়ার সার্ভিসের এই কর্মকর্তা। জাহাঙ্গীর হোসেনের একাধিক সহকর্মীর সাথে কথা বলে জানা যায়, গত রোববার দিবাগত রাতে ফতুল্লার সস্তাপুর এলাকায় একটি পোশাক কারখানায় অগ্নিকা-ের ঘটনায় ডিউটিতে ছিলেন তিনি। ফজরের আযানের সময় তিনি গাড়িসহ স্টেশনে ফেরেন। সহকর্মীদের সাথে নামাজ পড়ে বিশ্রাম নিয়ে আবার সকাল ৮টা থেকে ডিউটি শুরু করেন। সকাল সাড়ে ১০টায় বিসিক শিল্পনগরীতে অপর একটি পোশাক কারখানায় অগ্নিকা-ের খবর পেয়ে গাড়ি নিয়ে বের হন। তবে বের হওয়ার সময় তার শারীরিক কোনো অসুস্থতা লক্ষ করেননি সহকর্মীরা। ফায়ার সার্ভিসের একজন কর্মী টানা ৪৮ ঘণ্টা ডিউটি করেন। টানা ডিউটির পর ২৪ ঘণ্টা তিনি বিশ্রাম করেন বলে জানান ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তা ফখর উদ্দিন আহাম্মদ।




Your email address will not be published.

Comments are closed.


আজকের পত্রিকা
আজকের পত্রিকা
ফেসবুকে আমরা
পুরনো সংখ্যা
সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি রবি
 
১০
১১১২১৩১৪১৫১৬১৭
১৮১৯২০২১২২২৩২৪
২৫২৬২৭২৮২৯৩০৩১
Copyright © Dundeebarta 2024
ডান্ডিবার্তা