ডাম্পিংয়ে নেয়া গাড়ির জরিমানার অর্থ অর্ধেকই গায়েবের অভিযোগ
ডান্ডিবার্তা রিপোর্ট
নারায়ণগঞ্জে অবৈধভাবে চলাচল করা ইজিবাইক থেকে ট্রাফিক পুলিশের পরিদর্শকসহ কয়েকজন সদস্য ‘বাড়তি রোজগারে নেমেছেন’। অভিযোগ রয়েছে, প্রায় প্রতিদিনই অভিযান চালিয়ে যে পরিমাণ তিন চাকার যান আটক করা হয়, ডাম্পিংয়ে নেওয়ার পর সেগুলো জরিমানার অর্ধেক টাকাই গায়েব হয়ে যায়। এমনকি ইজিবাইকচালকদের কাছ থেকে যারা চাঁদা তোলেন তাদের সঙ্গে সখ্য রয়েছে পুলিশের এই সদস্যদের। ট্রাফিক বিভাগ থেকে জানা যায়, অবৈধভাবে চলাচল করা তিন চাকার যান আটক ও ডাম্পিংয়ের দায়িত্বে রয়েছেন ট্রাফিক পুলিশের পরিদর্শক (প্রশাসন) করিম শেখ। তাকে সহযোগিতা করেন চাষাঢ়া বক্সের ট্রাফিক পরিদর্শক মেহেদী হাসান ও পঞ্চবটি বক্সের পরিদর্শক হারুন। তবে আটকের মূল কাজ করেন অন্য চার পুলিশ সদস্য। তাদের মধ্যে রয়েছেন তিন উপসহকারী টাউন পরিদর্শক (এটিএসআই) আবু হানিফ, আবুল বাসার ও আবু সায়েম। এ ছাড়া সহিদুল ইসলাম নামে একজন পুলিশ সদস্য এ দায়িত্ব পালন করেন। তাদের নিয়ন্ত্রণে আছেন বহিরাগত আরও কয়েকজন। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রতিদিন সকালে ওই চারজন তাদের সহযোগীদের নিয়ে ইজিবাইক আটকের অভিযানে বের হন। শহরের নিতাইগঞ্জ থেকে শুরু করে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোডে থাকে তাদের অবস্থান। বিকেল পর্যন্ত তারা অভিযান চালিয়ে তিন চাকার যান আটক করেন। এ সময়ের মধ্যে আটক করা অটোরিকশা বা ইজিবাইক নিয়ে যাওয়া হয় চাষাঢ়া ডাম্পিং ইয়ার্ডে। সেখানে জরিমানা আদায় করেন চার পুলিশ সদস্যের কয়েকজন ‘ভাড়াটে ম্যানেজার’। একটি ইজিবাইক ছাড়াতে চালকদের দিতে হয় এক হাজার টাকা। চাষাঢ়া ডাম্পিংয়ে গত তিন দিন বিভিন্ন সময় গিয়ে দেখা যায়, গেটের সামনে থেকে পেছন পর্যন্ত কোথাও খালি জায়গা নেই। এখানে আটক করে রাখা হয়েছে তিন চাকার যানগুলো। ভেতরে ও আশপাশে চালকরা অবস্থান করেন। দুপুরের পর থেকে সেগুলোর জরিমানা নিয়ে ছাড়া হয়। পাশের একটি ভবনের উপর থেকে আটক করা যানগুলো গুনলে দেখা যায়, দিনভর অন্তত ২০০ ব্যাটারিচালিত ইজিবাইক, অটোরিকশা বা মিশুক ডাম্পিংয়ে রাখা হয়েছে। ডাম্পিংয়ের মূল ফটকের উল্টো পাশের একটি ভবনের সিটি ক্যামেরার ফুটেজ পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেছে, যতগুলো গাড়ি সারা দিন ভেতরে আনা হয়েছিল, সবই বের করা হয়েছে। এ হিসাবে প্রতিদিন অন্তত দুই লাখ টাকা জরিমানা আদায় হওয়ার কথা। তবে এ ডাম্পিংয়ের দায়িত্বে থাকা ট্রাফিক পুলিশের পরিদর্শক করিম শেখ দিয়েছেন ভিন্ন তথ্য। তিনি বলেন, ‘প্রতিদিন সর্বোচ্চ ৭০টির মতো তিন চাকার যান আটক করা হয়। তবে সবগুলো থেকে জরিমানা আসে না। কিছু কিছু তদবিরে ছেড়ে দিতে হয়।’ প্রত্যেকটি যান থেকে এক হাজার টাকা জরিমানা আদায় করা হয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এখানে অনেকেই গাড়ি ছাড়াতে তদবির করেন। এ ছাড়া চাবির রিং বা ভিজিটিং কার্ড দিয়ে যারা চালকদের কাছ থেকে চাঁদা নেন সেই চক্রও এখানে আছে। আমরা এ বিষয়ে কাজ করছি।’ চাঁদাবাজসহ অন্যদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানান তিনি। যদিও জরিমানার বিষয়ে বিস্তারিত কিছুই বলেননি। এটিএসআই আবু হানিফ, আবুল বাসার, আবু সায়েম এবং পুলিশ সদস্য সহিদুল ইসলামের সঙ্গে কথা হয় খবরের কাগজের প্রতিবেদকের। তাদের বিরুদ্ধে ইজিবাইক আটকে দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে জানানো হলে সবাই পরিদর্শক করিম শেখের সঙ্গে কথা বলতে বলেন। যদিও এ বিষয়ে পরিদর্শক করিম শেখ কোনো মন্তব্য করেননি। তবে ইজিবাইকচালকরা দিয়েছেন জরিমানা গায়েবের আসল তথ্য। ডাম্পিংয়ে আটক করে আনা সব ইজিবাইক থেকে জরিমানা আদায় করা হলেও দেওয়া হয় না সরকারি রিসিট। বেশির ভাগ চালকের কাছ থেকে জরিমানার টাকা নেওয়ার পর তাদের চলে যেতে বলা হয়। শুধুমাত্র রিসিট কাটা জরিমানার টাকাই যায় রাজস্ব খাতে। রুবেল মিয়া নামে এক চালক ডাম্পিং ইয়ার্ড থেকে আটক হওয়া ইজিবাইক ছাড়াতে আসেন। কথা হয় তার সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘সকালে দিগু বাজার থেকে সবজি নিয়ে যাওয়ার সময় ট্রাফিক পুলিশের লোকজন গাড়ি আটক করেন। এখন ছাড়িয়ে নিলাম। জরিমানা এক হাজার টাকা নিয়েছে, কিন্তু কোনো রিসিট দেয়নি। আগেও বহুবার গাড়ি ধরা পড়েছে। তারা কখনো রিসিট দেয়, আবার কখনো দেয় না। সবই তাদের ইচ্ছা। আমাদের কাছ থেকে যারা চাঁদা তোলেন তারাও ডাম্পিংয়ের ভেতরে বসে থাকেন।’ আটক করা তিন চাকার যানের মধ্যে বেশির ভাগকেই রিসিট দেওয়া হয় না বলে জানান রমজান আলী। তিনি এ ডাম্পিং থেকে মাসে প্রায় চার থেকে ছয়বার ইজিবাইক ছাড়াতে আসেন। তিনি বলেন, ‘ডাম্পিংয়ের ভেতরে টেবিল নিয়ে ম্যানেজাররা বসে থাকেন। যখন গাড়ি আটক করে তখন আমাদের নাম লিখে রাখেন। ম্যানেজারের কাছে গিয়ে নাম বললে তারা জরিমানার টাকা চান। এরপর এক হাজার টাকা দিলে তার লোক গাড়ি বুঝিয়ে দেন। ম্যানেজার কখনো কখনো জরিমানা আদায়ের রিসিট দেন, আবার কখনো দেন না। তবে না দেওয়ার সংখ্যাই বেশি।’ তিন চাকার যান আটক হওয়ার পর চালক তা ছাড়াতে তারাহুরা করেন জানিয়ে ইসমাইল হোসেন নামে আরেক ইজিবাইকচালক বলেন, ‘জরিমানা দিয়ে অটোরিকশা ছাড়ানোর পর আবার মহাজনের জন্য গাড়ির ভাড়া তুলতে হয়। তাই গাড়ি ছাড়ানোর পর সবাই চালাতে যেতে ব্যস্ত থাকেন।’ ডাম্পিংয়ে হওয়া অনিয়মের বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে ট্রাফিক পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রুহুল আমিন সাগর খবরের কাগজকে জানান, বিষয়টি তার জানা নেই। রিসিট না দিয়ে তিন চাকার যান ছাড়ার বিষয়টিও তিনি জানতেন না। ট্রাফিক পুলিশের এই কর্মকর্তা বলেন, ‘যদি কোনো পুলিশের সদস্য এখানে অনিয়মন করেন আর তার প্রমাণ পাওয়া যায় তাহলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’