আজ শুক্রবার | ২৭ জুন ২০২৫ | ১৩ আষাঢ় ১৪৩২ | ১ মহর্‌রম ১৪৪৭ | বিকাল ৪:১৮

এখন চনপাড়ার ডন কে?

ডান্ডিবার্তা | ২৭ জুন, ২০২৫ | ১২:১৩ অপরাহ্ণ

ডান্ডিবার্তা রিপোর্ট
“এই চনপাড়ার ইতিহাসই এমন। এইখানে ভালো মানুষ কেউ থাকে না। কেউ একটু টাকা-পয়সা কামাইতে পারলেই এলাকা ছাইড়া চইলা যায় অন্য জায়গায়। যারা তারপরও থাকে, তাগো অন্য স্বার্থ আছে।” কথাগুলো বলছিলেন স্থানীয় মুদি দোকানি মো. সোহেল। তার ভাষায়, টাকাপয়সার মালিক হতে না পারায় তাকে চনপাড়াতেই থেকে যেতে হয়েছে, দেখতে হয়েছে অনেক কিছু। ‘চনপাড়া’ নারায়ণগঞ্জের একটি ওয়ার্ড, কিন্তু মাদক কারবারি আর অপরাধীদের কাছে এ যেন রীতিমত এক রাজ্য, যার নিয়ন্ত্রণ নিতে সব পক্ষই মরিয়া। রাজধানীর অদূরে তিন দিক দিয়ে নদ-নদী বেষ্টিত এই ছোট্ট ভূখÐ এমন বিশিষ্ট হয়ে উঠেছে ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে। গতবছর অগাস্টে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর চনপাড়ার নিয়ন্ত্রণও হাতবদল হয়েছে। স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, আগে যেখানে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ ছিল, সেখানে এখন বিএনপির লোকজন বসেছে। এই সময়ে কিছু ‘লোক দেখানো’ প্রকাশ্য পরিবর্তন হয়েছে বটে, তবে মাদক ব্যবসার আধিপত্য নিয়ে খুন-গুম-চাঁদাবাজি-দ্ব›দ্ব যথারীতি অব্যাহত থাকায় ‘ভয়-ভীতি আর আতঙ্ক’ আগের মতই আছে। অগাস্টে নতুন লোকজন দায়িত্ব নেওয়ার পর গত দশ মাসে ‘অভ্যন্তরীণ বিরোধের জেরে’ চারটি খুন হয়েছে। হত্যাকাÐের শিকার এসব ভুক্তভোগী পরিবারের সদস্যদেরও আওয়ামী লীগের লোকজনের মত চনপাড়া ছেড়ে যেতে বাধ্য করা হয়েছে; অথবা তারা ভয়ে আর চনপাড়ার পথ মাড়াচ্ছেন না। চনপাড়ার এসব অলি-গলিতে আগে প্রকাশ্যে মাদকের বেচাকেনা হলেও এখন তা কমে এসেছে বলে স্থানীয়দের বলতে শোনা গেছে। চনপাড়ার বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে গত সপ্তাহে বেশ কিছু সময় ধরে কথা হয় মুদি দোকানি সোহেলের সঙ্গে। তিনি চনপাড়ার অনেক ঘটনার সাক্ষী। সোহেল বলছিলেন, “চনপাড়ায় আগে রাস্তাঘাটে মাদক বিক্রি চলত। কাউরেই কেউ পরোয়া করত না। এইটা এখন কমছে সত্য। কিন্তু বাকি যেইসব কাজ, যেমন এরে-ওরে ধইরা আইনা মাইর দেওয়া, টাকা আদায় করা- এইগুলা আগের মতই আছে। আগেও যেমন বুক ফুলায়ে কিছু বলা যাইত না, এখনও তাই। কোনোকিছু পাল্টায় নাই। পাল্টাইছে খালি সামনের মুখগুলা।” তবে চনপাড়ার মানুষ এখন ‘কিছুটা স্বস্তিতে আছে’ মন্তব্য করে এ দোকানি বলেন, “এখন তো প্রশাসন কারও পক্ষে না। অনেকেই প্রশাসনের ভয়ে চুপ। সামনে নির্বাচন। দলীয় সরকার আসলে পরিস্থিতি আবার খারাপের দিকে যাইতে পারে।”রূপগঞ্জ থানার ওসি লিয়াকত আলীর দাবি, আগস্টের পর চনপাড়ার মাদক ব্যবসা ও সন্ত্রাসী কার্যক্রম অনেক কমে এসেছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ‘নিরপেক্ষ’ ভূমিকা এতে জোরালো ভূমিকা রেখেছে।“চনপাড়ার ইতিহাসে এমনটা কখনও হয় নাই। এই পরিবর্তন ধরে রাখতে হবে। পুলিশের অবস্থান এখানে শক্ত। তাই কোনো রাজনৈতিক প্রভাব কাজ করছে না।”ওসি এমনটা দাবি করলেও তার থানাতেই আগস্টের পর থেকে গত কয়েক মাসে গড়ে অন্তত ১৫টি মাদক সংক্রান্ত মামলা হয়েছে; যার সঙ্গে চনপাড়ার সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। ছোট ছোট গলি আর ঘিঞ্জি পরিবেশের কারণে এখানে অভিযান চালানোও খুব কঠিন বলে মনে করেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। রূপগঞ্জ উপজেলার কায়েতপাড়া ইউনিয়নের চনপাড়া এক সময় ছিল ‘পুনর্বাসন কেন্দ্র’। ১৯৭৪ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকা পানি সরবরাহ ও পয়ঃনিষ্কাশন কর্তৃপক্ষের (ওয়াসা) ১২৬ একর জমির ওপর দেশের বিভিন্ন স্থানে নদী ভাঙন ও প্রাকৃতিক দুর্যোগে বাড়িঘর হারানো আশ্রয়হীন মানুষদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করেন। নাম দেওয়া হয় ‘চনপাড়া পুনর্বাসন কেন্দ্র’। শুরুতে সাড়ে পাঁচ হাজার পরিবারের পুনর্বাসন হলেও বর্তমানে চনপাড়ার বাসিন্দা লক্ষাধিক। ভোটার রয়েছেন প্রায় ২২ হাজার। ভোটার হালনাগাদের সবশেষ তালিকা ধরলে এ সংখ্যা আরও বেশি হবে। স্থানীয় বাসিন্দাদের ভাষ্য, চনপাড়ার ভাসমান লোকজন শুরুতে দিনমজুরের কাজ করতেন। তবে আশির দশকের শুরুর দিকে এই অঞ্চলে মাদক কেনাবেচা শুরু হয়। একাধিক ‘বাহিনী’ মাদক বেচা-কেনার পাশাপাশি চাঁদাবাজি, অপহরণসহ বিভিন্ন ধরনের অপরাধে জড়িত হয়ে পড়ে। রকাশ্যে মাদক বিক্রি ও ব্যবহার অনেকটা কমে গেলেও চনপাড়ায় এখনো ‘হোম সার্ভিস’ চালু আছে বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন। গত কয়েক বছরে ‘রাজনৈতিক ছত্রছায়ায়’ মাদক চোরাকারবারি ও অপরাধীদের ‘স্বর্গরাজ্যে’ পরিণত হয়েছে এ এলাকা। চনপাড়া গ্রামে স্থলপথে ঢোকার একমাত্র পথ ডেমরা থেকে বালু সেতু হয়ে। সেতু পার হলেই চনপাড়া মোড়। চনপাড়াকে নয়টি ওয়ার্ডে ভাগ করা হয়েছে। প্রতিটি ওয়ার্ডের অসংখ্য অলিগলি। বাড়িঘর একটার সঙ্গে অন্যটা লাগোয়া। চনপাড়ার দুই দিকে শীতলক্ষ্যা নদী এবং একদিকে বালু নদ। পাশের ডেমরা, নোয়াপাড়া ও মুড়াপাড়া থেকে নদীপথে চনপাড়ায় ঢোকা যায়। রয়েছে একাধিক খেয়াঘাট। স্থানীয় লোকজন ও পুলিশ জানায়, বেশিরভাগ মাদকের চালান চনপাড়ায় ঢোকে জলপথে। স্থলপথেও অভিনব কায়দায় মাদকের ছোট-বড় চালান আনা হয়। অস্ত্র কেনা-বেচাও চলে এখানে। এমনকি অপরাধীদের কাছে আত্মগোপনে থাকার জায়গা হিসেবেও চনপাড়া গুরুত্বপূর্ণ। খুনের পর খুন আওয়ামী লীগের সরকার পতনের পর সাত মাসে চনপাড়ায় চারটি খুনের ঘটনা ঘটেছে। ৫ অগাস্ট সন্ধ্যায় একটি আনন্দ মিছিল বের হয়। সেই মিছিলে আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীদের সশস্ত্র হামলার অভিযোগ ওঠে। হামলায় দশম শ্রেণির ছাত্র রোমান মিয়া গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায়। রোমান চনপাড়ার নবকিশলয় উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্র ছিল। পরদিন ৬ অগাস্ট রাতে নিখোঁজ হন মো. সৌরভ (২৬) ও সজীব হাওলাদার (২৮) নামে দুই বন্ধু। তিন দিন পর ৯ অগাস্ট চনপাড়ার ৬ নম্বর ওয়ার্ডের শীতলক্ষ্যা নদীর অফিস ঘাট থেকে সৌরভের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। স্বজনরা জানান, সেই মরদেহ ছিল বিভৎস। আট দিন পর ১৪ অগাস্ট দুপুরে সজীবের মরদেহের সন্ধান মেলে কয়েক কিলোমিটার দূরে বন্দর উপজেলার কলাগাছিয়া এলাকার নদীতে। তাদের স্বজনরা বলছিলেন, সৌরভ নারায়ণগঞ্জের সাইনবোর্ড এলাকায় একটি যাত্রী পরিবহনের কাউন্টারে টিকেট বিক্রয়কর্মী হিসেবে কাজ করতেন। আর সজীব চনপাড়ার অদূরে ডেমরা মীরপাড়া এলাকায় ‘ভেলপুড়ি’ বিক্রি করতেন। ঘটনার দিন দুই বন্ধু একসঙ্গেই চনপাড়াতে গিয়েছিলেন। ওই সময় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নাজুক থাকায় দুটি হত্যাকাÐের ঘটনাতেই পরিবারের সদস্যরা থানায় না গিয়ে আদালতে মামলা করেন। একটির বাদী সৌরভের স্ত্রী বৃষ্টি আক্তার এবং অন্যটির সজীবের স্ত্রী রাবেয়া বেগম। তবে এখন ওই হত্যাকাÐের বিষয়ে কথা বলতে তারা খুব একটা আগ্রহী নন। এর পেছনে ‘ভয়ের’ কথাও স্বীকার করেছেন তারা। দুই মামলার বাদীই ঘটনার পর থেকে আর চনপাড়া যাননি। দুজনেই থাকেন অন্য এলাকায় বাবার বাড়িতে। তবে স্থানীয়রা বলছেন, চনপাড়ার অন্যতম মাদক ব্যবসায়ী জয়নাল আবেদীনের সঙ্গে সজীব ও সৌরভের সখ্যতা ছিল। আওয়ামী লীগ আমলে দলটির নেতাদের আশ্রয়ে-প্রশ্রয়ে সহযোগীদের দিয়ে মাদক ব্যবসার বড় একটি অংশ নিয়ন্ত্রণ করতেন জয়নাল। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর জয়নালের সঙ্গে সখ্যতাকে কেন্দ্র করেই প্রতিপক্ষের হাতে খুন হয়ে থাকতে পারেন সৌরভ ও সজীব। সবশেষ ১৮ মার্চ রাতে সংঘর্ষের ঘটনায় গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান চনপাড়ার ৬ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা মো. হাসিব (২৮)। ওই সংঘর্ষে আরও দুজন গুলিবিদ্ধ হন। স্বজনরা জানান, ওই রাতে রবিন নামে এক মাদক ব্যবসায়ীকে আটক করেন চনপাড়া সাংগঠনিক ইউনিয়ন যুবদলের সভাপতি মনির দেওয়ানের অনুসারীরা। পরে তাকে স্থানীয় যুবদল কার্যালয়ে নেওয়া হয়। কিন্তু তাকে ছাড়িয়ে নিতে সেখানে যান ইউনিয়ন যুবদলের সাংগঠনিক সম্পাদক আব্দুল করিম এবং ২ নম্বর ওয়ার্ড যুবদলের সভাপতি গোলাম রাব্বানী। এ নিয়ে উভয়পক্ষের মধ্যে হাতাহাতি হয়। পরে তা সংঘর্ষের রূপ নেয়। নিহত হাসিবের ভাই মো. বাবু এ ঘটনায় থানায় একটি হত্যা মামলা করেন। ওই মামলায় করিম, রাব্বানী ও তাদের ঘনিষ্ঠ সহযোগী শাকিলসহ ১৭ জনের নাম বলা হয়েছে। মামলার বাদী বাবু নিজেকে যুবদল কর্মী বলে পরিচয় দেন। তিনি স্থানীয়ভাবে শামীম মিয়ার ঘনিষ্ঠ অনুসারী বলে পরিচিত। ওই ঘটনায় রবিনকে অপহরণের অভিযোগে আদালতে আরেকটি মামলা হয়। ওই মামলায় শামীম মিয়া, হাসিবের ভাই বাবুসহ তাদের ঘনিষ্ঠজনদের আসামি করা হয়। ওই সংঘর্ষের ঘটনার পর র‌্যাব ও পুলিশের একাধিক বিশেষ অভিযান চলে। পাল্টাপাল্টি মামলায় উভয়পক্ষের লোকজন আসামি হওয়ায় দুই পক্ষই বেকায়দায় পড়ে। করিম, রাব্বানী ও শাকিল গ্রেপ্তার হয়ে এখন জেলে আছেন।




Your email address will not be published.

Comments are closed.


আজকের পত্রিকা
আজকের পত্রিকা
ফেসবুকে আমরা
পুরনো সংখ্যা
সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি রবি
 
১০১১১২১৩১৪১৫
১৬১৭১৮১৯২০২১২২
২৩২৪২৫২৬২৭২৮২৯
৩০  
Copyright © Dundeebarta 2024
ডান্ডিবার্তা