আজ রবিবার | ২০ জুলাই ২০২৫ | ৫ শ্রাবণ ১৪৩২ | ২৪ মহর্‌রম ১৪৪৭ | দুপুর ২:১৭

যান্ত্রিকের ভিড়ে হারিয়ে যাচ্ছে কাঠের নৌকা

ডান্ডিবার্তা | ২০ জুলাই, ২০২৫ | ৯:৫১ পূর্বাহ্ণ

ডান্ডিবার্তা রিপোর্ট
নদীমাতৃক আবহমান গ্রাম বাংলার লোকসংস্কৃতির অন্যতম ধারক বাহক ঐতিহ্যবাহী কাঠের তৈরি সব নৌকা হারিয়ে যেতে বসেছে। যান্ত্রিক সভ্যতার ভিড়ে বিলুপ্ত প্রায় কাঠের তৈরি নৌকা। নদীমাতৃক বাংলাদেশে একসময় নৌকাই ছিল আদি বাহন। নদীতে সারি সারি পালতোলা নৌকার সেই মনোমুগ্ধকর দৃশ্য এখন আর চোখে পড়ে না। নৌকা এখন শুধুই স্মৃতি। কালের বিবর্তন, জৌলুস হারানো নদ-নদীর করুণ অবস্থা ও যান্ত্রিক সভ্যতা বিকাশে বর্তমানে বিলুপ্ত প্রায় আবহমান গ্রামবাংলার লোকসংস্কৃতির অন্যতম ধারক ঐতিহ্যবাহী কাঠের তৈরি নৌকা। নদ-নদী বেষ্টিত এলাকার বেশিরভাগ মানুষের দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গে নিবিড়ভাবে সম্পৃক্ত ছিল এই নৌকা। বর্ষায় ভরা নদ-নদীর ঢেউ আর পালের নৌকা, ডিঙ্গি নৌকাসহ হরেক রকমের নৌকার সম্পর্ক। নব্বইয়ের দশকেও নারায়ণগঞ্জের নদ-নদীগুলোর নৈসর্গ রূপের সৌন্দর্য ছিল সারি সারি নৌকা। এসব নৌকায় ছিল রঙিন পাল, স্বচ্ছ পানির কলতান আর পালে লাগা বাতাসের শব্দ অনুভূতি জুগিয়েছে প্রাণে। সারি সারি নৌকার ছন্দবদ্ধ চলা আর বাতাসে পাল ওড়ার মনোরম দৃশ্য দেখে মনপ্রাণ আনন্দে নেচে উঠতো সবার। নদ-নদী গুলোর ওপর ব্রিজ তৈরি হওয়াতে নদীপথে মানুষ খুব একটা পারাপার হয় না। কিছু কিছু এলাকায় নৌকা চলাচল করলেও তেমন কদর নেই। কদর নেই মাঝি-মাল্লাদেরও। নৌকায় পাল এবং দাঁড়-বৈঠার পরিবর্তে ব্যবহৃত ইঞ্জিন চালিত লোহার তৈরি শ্যালোনৌকা। সময়ের চাকা ঘোরার সঙ্গে সঙ্গে আধুনিকতার ছোঁয়ায় বদলে গেছে যাতায়াত ব্যবস্থাও। কাঁচপুর- শিমরাইল, তারাব-ডেমরা, মুড়াপাড়া-কায়েতপাড়া, কাঞ্চন-পূর্বাচল এক্সপ্রেসওয়েসহ একাধিক সেতু শীতলক্ষ্যার বুকে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে নতুন নতুন পথ। এখন অটোরিকশা, প্রাইভেটকার, বাসে করেই মানুষ সহজে নদী পার হয়। ফলে নৌকার ওপর নির্ভরশীলতা কমে এসেছে আশঙ্কাজনক হারে। এক সময় শীতলক্ষ্যা নদী ছিল পূর্বাঞ্চলের মানুষের জীবনরেখা। নদী ছিল পথ, নৌকা ছিল বাহন, আর মাঝি ছিল সাহসী পথপ্রদর্শক। সেতু-সড়কহীন সেই সময়ে মানুষের যাতায়াতের একমাত্র ভরসা ছিল নৌকা। আজও নদীর বুক চিরে মাঝেমধ্যে ভেসে ওঠে সেই পরিচিত দৃশ্য-একজন বৃদ্ধ মাঝি দাঁড় হাতে গেয়ে চলেছেন কোনো লোকগান, আর সামনে বসে থাকা যাত্রীরা নদীর হাওয়া গায়ে মেখে এগিয়ে চলেছেন জীবনের দিকে। কিন্তু সেই দৃশ্য এখন দুর্লভ, বিলুপ্তপ্রায়। শীতলক্ষ্যা নদীর গা ঘেঁষে গড়ে ওঠা রূপগঞ্জের মুড়াপাড়া-রুপগঞ্জ, চনপাড়া- নোয়াপাড়া, তারাব-ডেমরা, কিংবা পূর্বাচল সংলগ্ন ঘাটগুলোতে একসময় প্রতিদিন হাজারো মানুষ পার হতেন এই কাঠের তৈরি নৌকায়। ছাত্র, কৃষক, দিনমজুর থেকে শুরু করে পীর-আউলিয়ারা পর্যন্ত এই সরল নৌযানেই চলাচল করতেন। হাটে পণ্য নিয়ে যেতেন কৃষকেরা-নৌকাই ছিল জীবনের সঙ্গী। নৌকা শুধু বাহন ছিল না, এটি ছিল একটি জীবনযাপন, একটি সংস্কৃতি, একটি আবহমান বাংলার প্রতিচ্ছবি। উপজেলার শীতলক্ষ্যা ও বালু নদীতে বিভিন্ন ধরনের নৌকার প্রচলন ছিল যেমন ছিপ, বজরা, ময়ূরপঙ্খী, গয়না, পানসি, কোষা, ডিঙ্গি, ছৈওয়ালা, পাতাম, বাচারি, রফতানি, বউপলানোসহ ইত্যাদি নামের বাহারি সব নৌকা। নব্বই দশক থেকে বাংলাদেশে নৌকায় ইঞ্জিন লাগানো শুরু হয়। তখন থেকে নৌকা একটি যান্ত্রিক বাহনে পরিণত হয়। এ যান্ত্রিক নৌকাগুলো শ্যালো নৌকা নামেও পরিচিত। তারপরও শীতলক্ষ্যার বুকের কিছু ঘাট এখনো কাঠের তৈরি নৌকাকে ধরে রেখেছে। সকাল-বিকেল দেখা মেলে ৬০ বছরের বৃদ্ধ মাঝির, যার হাতে এখনো শক্তি আছে দাঁড়া চালানোর। তাদের কেউ কেউ বলেন, নদীই আমার জীবন। নদীর ওপরই বাড়ি-সংসার। তাদের হাতে নেই মোবাইল, নেই ডিজিটাল টিকিট, কিন্তু আছে নদীকে ভালোবাসার অদ্ভুত টান। কারণ এই ডিঙ্গিই তো তাদের জীবনের একমাত্র জীবিকা। এসব কেবল চলাচলের উপায় নয়, এগুলো একেকটি লোকজ নান্দনিকতার নিদর্শন। লোকসংগীতে, কবিতায়, চিত্রকলায় বারবার উঠে এসেছে এসব নৌকার নাম। ‘নাও বাইয়া যাও রে মাঝি’ এই গানের প্রতিটি শব্দে মিশে আছে বাঙালির নদীমাতৃক আত্মা। কিন্তু আজ এই আত্মা ক্লান্ত, অবহেলিত। সাহিত্য-সংস্কৃতিতে যে নৌকা ছিল এত বছর ধরে জীবন্ত, বাস্তবে তার অস্তিত্ব আজ হুমকির মুখে। নতুন প্রজন্ম জানেই না কেমন ছিল এক নৌকা ভ্রমণ, কেমন ছিল মাঝি-যাত্রীর সেই অনন্য সম্পর্ক। উপজেলার রূপগঞ্জ এলাকার মাঝি দেলোয়ার হোসেন বলেন, ‘আগে খালে-বিলে-নদীতে কত রকম নৌকা চলত। সেইসব দিনগুলা অহন শুধুই স্মৃতি। অহন আর মাঝিকে গুণ টাইনা নৌকা চালাইতে হয় না, পরিশ্রম ছাড়াই স্যালু মেশিন দিয়াই চলে। আহন সব উন্নত অইছে। কিন্তু গ্রাম বাংলার ঐতিহ্য কাঠের তৈরি নৌকা ধীরে ধীরে বিলীন হইয়া যাইতাছে।’ বৃদ্ধ মাঝি লাল মিয়া জানান, ৪০ বছর ধরে রূপগঞ্জ থানার ঘাটে নৌকা চালাচ্ছেন তিনি। এখন আর আগের মতো লোক আসে না। প্রতিদিন সকাল থেকে রাত অব্দি ঘাটে থাকেন। ৫ থেকে ৬ শত টাকা আয় হয়। তিনি বলেন, ‘নদীর সঙ্গেই বেঁধে ফেলেছি জীবনটা তাই এই পেশাটা আর ছাড়তে পারতেছিনা না।’ রূপগঞ্জ থানা ঘাটে কথা হয় নৌকা যাত্রী নুর আলমের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘নৌকায় চড়লে এক ধরনের শান্তি পাই। ছোটবেলার কথা মনে পড়ে যায়। নৌকা শুধু একটি বাহন নয়, এটি বাঙালির নদী ঘেঁষা ইতিহাস ও সংস্কৃতিরই এক প্রতীক।’ এখানকার একজন নৌকা যাত্রী শামীমা বেগম জানান, এক সময়কার প্রাত্যহিক জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল এই ছোট্ট নৌকাগুলো। আজ সেই নৌকা যেন কালের গর্ভে হারিয়ে যেতে বসেছে। তবে কিছু মাঝি এখনো হাল ছাড়েননি। তারা বাঁচিয়ে রেখেছেন এই ঐতিহ্য, যেটা শহরের কোলাহলে চাপা পড়ে গেলেও নদীর বুকের মাঝে আজো বয়ে চলে। কায়েতপাড়া ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট গুলজার হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, ‘দিন দিন বাড়ছে আবাসনের চাপ, নদী হারিয়েছে নাব্যতা, জলাশয়গুলো বালি ফেলে ভরাট করা হচ্ছে। অন্যদিকে আধুনিকতার ছোঁয়ায় এসেছে বেশ পরিবর্তন। এক সময় এসব নৌকাই ছিল মানুষজনের যাতায়াত ও পরিবহনের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য মাধ্যম। হারিয়ে যাওয়া গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী দৃষ্টিনন্দন নৌকায় নদীভ্রমণে তৃপ্ত হতো আমাদের মন। সারি সারি নৌকার ছন্দবদ্ধ চলা আর বাতাসে পাল ওড়ার মনোরম দৃশ্য দেখে মানুষের মনপ্রাণ ভরে যেত। কিন্তু সেই চিরচেনা দৃশ্যটি এখন বিলুপ্তির পথে। এখন সময় এসেছে এই সংস্কৃতিকে সংরক্ষণের। প্রয়োজন এখনই এই ঐতিহ্যকে রক্ষা করার। স্থানীয় প্রশাসন চাইলে পারাপারের কিছু নির্ধারিত ঘাটকে সংস্কৃতি রুট হিসেবে ঘোষণা করতে পারে। ডিঙ্গি নৌকাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠতে পারে নদীকেন্দ্রিক পর্যটন। স্থানীয় পর্যটন কেন্দ্র বা ঘাটভিত্তিক ঐতিহ্য সংরক্ষণের উদ্যোগ নিলে এই হারানো ঐতিহ্যকে আবারও সামনে নিয়ে আসা যেতে পারে।’

 




Your email address will not be published.

Comments are closed.


আজকের পত্রিকা
আজকের পত্রিকা
ফেসবুকে আমরা
পুরনো সংখ্যা
সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি রবি
 
১০১১১২১৩
১৪১৫১৬১৭১৮১৯২০
২১২২২৩২৪২৫২৬২৭
২৮২৯৩০৩১  
Copyright © Dundeebarta 2024
ডান্ডিবার্তা