আজ বুধবার | ৩০ জুলাই ২০২৫ | ১৫ শ্রাবণ ১৪৩২ | ৪ সফর ১৪৪৭ | সকাল ৯:৩০

উত্তরায় যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হওয়ার আগে ঠিক কী করেছিলেন পাইলট তৌকির

ডান্ডিবার্তা | ২৭ জুলাই, ২০২৫ | ১০:৪৭ পূর্বাহ্ণ

ডান্ডিবার্তা ডেক্স
ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট তৌকির ইসলামের মিশনটা ছিল এ রকম যে সে রানওয়ের ওপর ১৫ থেকে ২০ মিনিট ম্যাক্সিমাম ফ্লাই করবে। ছোট্ট একটা মিশন। যেহেতু এটা ছিল তার প্রথম সলো বা একক ফ্লাইট। সকালবেলা তৌকির কিন্তু একটা চেক রাইডে গেছে। একটা মিশন করেছে। এটা কে নিয়েছে? এটা তার কমান্ডিং অফিসার নিয়েছে। এটা একটা পরীক্ষার মতো। যখন দেখা গেছে, তৌকির ফিট ছিল, তখন তাকে সলো ট্রিপে পাঠানো হয়েছে। কমান্ডিং অফিসার কী করে? সে নিজে যেখান থেকে টেকঅফ করবে, ওইটার পাশে এয়ার ট্র্যাফিক কন্ট্রোলের পাশে একটা মোবাইল হাট, একটা ভ্যানের মতো আছে, সেখানে সেম রেডিও ইকুইপমেন্ট নিয়ে একজন পাইলট সব সময় থাকে। এ রকম গুরুত্বপূর্ণ মিশনে কমান্ডিং অফিসার নিজেই চলে যায় এবং সে সেখানে ছিল। তার কাছে রেডিও থাকে, সবকিছু শুনছে। ইচ্ছা করলে কথাও বলতে পারে। তো সেভাবে সে টেকঅফ করে গেছে। এই মিশন এ রকম যে ওখান থেকে দেখা যায়। পুরোটা সময়ই সে ভিজিবল (দৃশ্যমান) ছিল। তৌকিরকে পুরোটা সময়ই দেখা গেছে। তার কমান্ডিং অফিসার নিজের চোখে দেখছে। এয়ার ট্র্যাফিক কন্ট্রোলার দেখছে। সে পাইলট না হোক, অফিসার কমান্ডার নিজে তো পাইলট। সে–ই তাঁকে ক্লিয়ার করছে। সে দেখছে, সবকিছু ঠিকঠাক আছে। ফ্লাইংয়ে কোনো ধরনের সমস্যা নেই। প্রথম একটা রাউন্ড করল, দ্বিতীয় একটা রাউন্ড করল। তারপর তৃতীয় রাউন্ড করে ল্যান্ড করতে আসবে, এতটুকুই। এমন সময়, অর্থাৎ তৃতীয় রাউন্ডের সময় কমান্ডিং অফিসার খেয়াল করল, তৌকির যখন উত্তরা বা টঙ্গীর দিক থেকে ঘুরে আসে। এদিকে টেকঅফ করেছে নিকুঞ্জের দিকে, ল্যান্ড করবে ওই দিক থেকে এসে। ও যখন আসছে, ল্যান্ড করার কথা না, ফ্লাই করার কথা। সে যখন তিন থেকে চার কিলোমিটার দূরে তখন কমান্ডিং অফিসার দেখল, তৌকির মনে হয় হাইট লুজ করছে। এটা কিন্তু বাইনোকুলার দিয়ে দেখা যায়। দেখে মনে হলো, তার (তৌকির) হাইট পড়ে যাচ্ছে। এমনিতেই তো বিমান ১ হাজার ৫০০ ফুট হাইটে ছিল। ১০ সেকেন্ডে পার কিলোমিটার যায়। আমাদের জন্য এটা কোনো স্পিড না। আমরা তো সুপারসনিক স্পিডেও ফ্লাই করি। সে আসছে, খুব লোয়ার সাইডের স্পিডে। তো সে আসছে আর কমান্ডিং অফিসার দেখছে, আরে প্লেনটা তো আস্তে আস্তে নিচে নেমে যাচ্ছে। কিন্তু ওর তো নামার কথা না; ওর তো একই হাইটে যাওয়ার কথা। তখন কমান্ডিং অফিসার তৌকিরকে কল দিয়ে বলল, ‘চেক ইয়োর হাইট।’ ‘চেক ইয়োর হাইট’ বলার পর ‘রজার’ আমরা বলি ‘কপিড’। তখন কমান্ডিং অফিসার ভেবেছে যে তৌকিরের বিমান বোধ হয় ভুলক্রমে নেমে গেছে। ১ হাজার ৫০০ ফুটের জায়গায় ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ৩০০ ফুটে নেমে গেছে। পরে সে দেখল, আরে, বিমান তো ওপরে উঠছে না, ক্রমাগত নিচে নামছে। তখন তার মনে হলো যে তৌকিরের বিমান তো খুব দ্রæত নামছে। তখন কমান্ডিং অফিসার দুবার তৌকিরকে বলছে, ‘ইজেক্ট ইজেক্ট’। ইজেক্ট হলো প্রতিটি এয়ারক্রাফটে একটা ইজেকশন সিট থাকে। পাইলট ইচ্ছা করলে একমুহূর্তে ইজেক্ট করে বের হয়ে যেতে পারে। এক সেকেন্ডের মধ্যে পাইলট বের হয়ে যেতে পারে। আমাদের ট্রেনিংটা এ রকম—পাইলট তখনই ইজেক্ট করে, যখন সে মনে করে যে সে এই প্লেনটাকে আর সেফলি ল্যান্ড করতে পারবে না। যখন বিমান ধ্বংসের দিকে যাচ্ছে বা পাইলট মারা যাচ্ছে, তখন পাইলট যে কাজটা করে, তা হলো, ইজেক্ট। যখন কমান্ডিং অফিসার দেখল যে বিমানটা ডেঞ্জারাস, নিচে নেমে গেছে, তখন ফাইনাল কমান্ড সে নিজে করে বলেছে, ইজেক্ট। দুবার বলেছে ইজেক্ট, ইজেক্ট। কিন্তু ও কোনো রিপ্লাই দেয়নি। তার মানে, পাইলট তখন ব্যস্ত ছিল বিমান নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার জন্য এবং এটা অস্বাভাবিক কোনো ঘটনা নয়। আমার জীবনেও এ রকম ঘটনা ঘটেছে। আমি বিমানের কন্ট্রোল নেওয়ায় ব্যস্ত ছিলাম। তারপর যখন দেখলাম, চারদিকে ডাকাডাকি হচ্ছে, তখন উত্তর দিয়েছি। যখন আমি বিমানকে নিয়ন্ত্রণে নিতে পেরেছি, তখন কমান্ডিং অফিসারের মেসেজের উত্তর দিয়েছি। যদি আমি ক্রাশ করে যেতাম, তাহলে তো উত্তর দিতে পারতাম না, কেউ জানত না কী ঘটেছিল ওই সময়! তাই আমার কাছে মনে হয়েছে, যান্ত্রিক ত্রæটির কারণে উত্তরায় মাইলস্টোন কলেজের ওপর এই দুঃখজনক বিমান দুর্ঘটনা ঘটেছে। এখানে পাইলটের কোনো গাফিলতি ছিল না বলেই আমার কাছে মনে হয়েছে। অনেকেই না জেনে বলেছেন, বিমান অনেক পুরোনো ও ত্রæটিপূর্ণ। উত্তরায় মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ভবনে বিমানবাহিনীর প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনায় উদ্ধার অভিযান চলছে। আমি বলব, বিমান ত্রæটিমুক্ত ও পাইলট ফিট ছিল বলেই তাকে এই সলো ফ্লাইট অপারেট করতে দেওয়া হয়েছিল। এফটি-৭ যুদ্ধবিমান ২০১৩ সালে চীনে তৈরি। খুব বেশি দিন আগের না এসব বিমান। সবশেষে বলব, দুর্ঘটনার আগে ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট তৌকির চেষ্টা করেছিল বিমান নিয়ন্ত্রণে রাখতে, কিন্তু পারেনি। উল্টো বিধ্বস্ত হয়ে এতগুলো কোমলমতি শিক্ষার্থীর করুণ মৃত্যু হয়েছে। এটাকে নিয়তি হিসেবেই ধরে নিতে হবে!
বিমানবাহিনীর সাবেক সহকারী প্রধান এবং বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের সাবেক চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল (অব.) এম সানাউল হকের সঙ্গে কথা বলে লেখাটি তৈরি করেছেন প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি বায়েজিদ আহমেদ।

 




Your email address will not be published.

Comments are closed.


আজকের পত্রিকা
আজকের পত্রিকা
ফেসবুকে আমরা
পুরনো সংখ্যা
Copyright © Dundeebarta 2024
ডান্ডিবার্তা