আজ শনিবার | ১৬ আগস্ট ২০২৫ | ১ ভাদ্র ১৪৩২ | ২১ সফর ১৪৪৭ | সকাল ৭:৩৮

বিএনপি ও এনসিপির মধ্যে টানাপোড়ন

ডান্ডিবার্তা | ১৪ আগস্ট, ২০২৫ | ১১:৫০ পূর্বাহ্ণ

ডান্ডিবার্তা রিপোর্ট
গত এক বছরে এশিয়া ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে একের পর এক বৈপ্লবিক আন্দোলন ও রাজনৈতিক ঝাঁকুনি দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। তরুণেরা রাস্তায় নেমে জবাবদিহিমূলক সরকার, ন্যায়ভিত্তিক সমাজ ও কর্মসংস্থানের দাবিতে বিক্ষোভ করেছেন। মানবাধিকারকর্মী বিনাইফার নওরোজি এই তরঙ্গকে যথার্থভাবে ‘ইয়ুথকোয়েক’ বা ‘তরুণকম্প’ বলে অভিহিত করেছেন। সবচেয়ে নাটকীয় পরিবর্তন ঘটেছে বাংলাদেশে। সেখানে সরকারি চাকরির কোটাব্যবস্থার রাজনীতিকীকরণ নিয়ে সৃষ্ট ক্ষোভ ধীরে ধীরে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে শেষ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কর্তৃত্ববাদী সরকার উৎখাতের আন্দোলনে রূপ নেয় এবং এর মধ্য দিয়ে এশিয়ার ‘আয়রন লেডি’র পতন ঘটে। কেউ কেউ হাসিনার পতনকে কর্তৃত্ববাদের বিরুদ্ধে জনতার সাহসী সংগ্রামের বিজয় হিসেবে উদ্‌যাপন করেছেন। কিন্তু বহু আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক এটিকে অশান্তি ও অনিশ্চয়তায় ভরা এক নতুন সময়ের সূচনা হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। কেউ কেউ আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন, এতে ইসলামপন্থী সহিংসতা ও ভূরাজনৈতিক উত্তেজনা বাড়তে পারে। আবার অন্যদের মতে, এই বিদ্রোহ মূলত আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) চাপানো উদারনৈতিক অর্থনৈতিক সংস্কারের প্রতি জনসাধারণের ক্ষোভ থেকে উঠে এসেছে। অর্থনীতিবিদ জেফরি স্যাকস আরও এক ধাপ এগিয়ে এই গণ-অভ্যুত্থানকে যুক্তরাষ্ট্র-সমর্থিত সরকার পরিবর্তনের অভিযান বলে আখ্যা দিয়েছেন। কিন্তু এসব ব্যাখ্যা–বিশ্লেষণে ক্ষমতার একেবারে তলানি থেকে উঠে আসা তরুণদের নেতৃত্বে হওয়া বিপ্লবের বিরাট সম্ভাবনাকে উপেক্ষা করা হয়েছে। হাসিনার পতনের পর গত এক বছরে বৈশ্বিক বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখেও বাংলাদেশের তরুণদের আন্দোলন আরও শক্তিশালী হয়েছে। ফলে দুর্নীতি ও গণতন্ত্রবিরোধী কর্মকা-ের বিরুদ্ধে শুরু হওয়া রাজপথের আন্দোলন এখন বিস্তৃত হয়ে কাঠামোগত সংস্কারের বৃহৎ আন্দোলনে পরিণত হয়েছে। গত একটি বছর আমাদের দেখিয়েছে, বিভিন্ন শ্রেণি থেকে আসা প্রযুক্তি-সচেতন এই তরুণদের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন যুগ যুগ ধরে গেড়ে থাকা পিতৃতান্ত্রিক রাজনীতি থেকে বেরিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে পারে। তবে আশঙ্কার কথা হলো, আমাদের এই আশাবাদ স্থায়ী না-ও হতে পারে। সবচেয়ে ভয়ের কথা হলো, সমাজে বড় ধরনের বিভেদ থাকায় বাংলাদেশের এই অভ্যুত্থান আরব বসন্তের মতো অল্প সময়ের মধ্যে শেষ হয়ে যেতে পারে। অভ্যুত্থান-পরবর্তী এক বছরে তরুণ কর্মীরা অন্তর্র্বতী সরকারকে টিকিয়ে রাখতে শুধু সহায়তাই করেননি, বরং তাঁরা নির্বাচনী গণতন্ত্রে রূপান্তরের ভিত্তিও তৈরি করেছেন। সামনের পথ এখনো যদিও চ্যালেঞ্জে ভরা, তবু পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি আশা জাগাচ্ছে। তরুণদের আন্দোলন নতুন নাগরিক সমাজের প্ল্যাটফর্ম তৈরিতে ভূমিকা রেখেছে। এটি অরাজনৈতিক গণ্যমান্য ও জ্ঞানীগুণী ব্যক্তিদের গুরুত্বপূর্ণ জন-আলোচনায় অংশ নিতে উৎসাহিত করেছে। ২০২৪ সালের আগস্ট থেকে নতুন তৃণমূল উদ্যোগ ও পেশাদারির সঙ্গে পরিচালিত বেসরকারি সংস্থা (এনজিও) নাগরিক সম্পৃক্ততায় নতুন ঢেউ তুলেছে। এর ফলে বৈষম্য মোকাবিলা, কাঠামোগত অসাম্য দূর করা এবং নির্বাচনের আগে জরুরি সংস্কার এগিয়ে নেওয়া নিয়ে স্থানীয় পর্যায়েও আলোচনার পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। তরুণদের এই আন্দোলন উল্লেখযোগ্য মাত্রায় প্রাতিষ্ঠানিক সাফল্য অর্জন করেছে। তরুণ সংগঠকেরা নোবেলজয়ী মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্র্বতী সরকারের জন্য সমর্থন সংগঠিত করেছেন। এর ফলে তাঁর দায়িত্বকাল বাড়ানো সম্ভব হয়েছে এবং তাঁর নির্বাচনী রোডম্যাপের জন্য দেশি ও আন্তর্জাতিক সমর্থন নিশ্চিত হয়েছে। তাঁরা বড় রাজনৈতিক দলগুলোকে একটি জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গঠনের পক্ষে দাঁড়াতে চাপ দিয়েছেন। এই কমিশন সংবিধান, বিচারব্যবস্থা, নির্বাচনব্যবস্থা, জনপ্রশাসন ও দুর্নীতি দমন—এই পাঁচ ক্ষেত্রে সংস্কার আলোচনাকে এগিয়ে নেবে। প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের দাবি তোলার পাশাপাশি তরুণ কর্মীরা বাংলাদেশের প্রথম ছাত্রসমাজের নেতৃত্বাধীন রাজনৈতিক দল ন্যাশনাল সিটিজেন পার্টি (এনসিপি) গঠন করে সরাসরি রাজনীতিতে প্রবেশ করেছে। আনুষ্ঠানিকভাবে নিবন্ধিত হতে পারলে দলটি ২০২৬ সালের শুরুতে অনুষ্ঠেয় নির্বাচনে তরুণ ভোটারদের জন্য ঐতিহ্যবাহী দলগুলোর বিকল্প হিসেবে নিজেদের তুলে ধরবে। বাংলাদেশের তরুণেরা রাস্তায় আন্দোলনের শক্তিকে কাজে লাগিয়ে দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি বদলানোর চেষ্টা করছেন। তাঁরা ভোটের বয়স ১৮ থেকে কমিয়ে ১৬ করার দাবি তুলছেন এবং অস্বচ্ছ বা বেআইনি রাজনৈতিক অনুদানের বদলে স্বচ্ছ, জনগণের অর্থায়নে নির্বাচনী তহবিল গঠনের পক্ষে কথা বলছেন। সবশেষে দেশের বড় বড় নেতার সঙ্গে যুক্ত হয়ে তরুণ ও নাগরিক সংগঠনগুলো অনেক বড় সাফল্য পেয়েছে। তারা সব প্রধান রাজনৈতিক দলকে একত্র করে ১৬৬টি সংস্কার নিয়ে আলোচনা করেছে। কয়েক মাস ধরে আলোচনা চালানোর পর জাতীয় ঐকমত্য কমিশন ‘জুলাই সনদ’ শীর্ষক একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণা দেবে বলে আশা করা হচ্ছে। এতে সংবিধান ও দেশের শাসনের জন্য যেসব গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনে সবাই সম্মত হয়েছে, তার তালিকা থাকবে এবং ভবিষ্যতে সেগুলো বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি থাকবে। এর মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালনের সময়সীমা নির্ধারণ, সংখ্যানুপাত অনুসারে (পিআর পদ্ধতি) দুই কক্ষবিশিষ্ট সংসদ গঠন, বিচার বিভাগ ও পুলিশকে স্বাধীন রাখা, বিরোধী দলকে আরও শক্তিশালী করা, আন্তর্জাতিক চুক্তি স্বাক্ষরে সংসদের অনুমোদন বাধ্যতামূলক করা, দুর্নীতি রোধে ও জনগণের কাছে জবাবদিহি নিশ্চিতে স্পর্শকাতর ইস্যুতে গণভোট ও তদারকির মতো নতুন নিয়ম চালু করা ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত হবে। গত একটি বছর আমাদের দেখিয়েছে, বিভিন্ন শ্রেণি থেকে আসা প্রযুক্তি-সচেতন এই তরুণদের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন যুগ যুগ ধরে গেড়ে থাকা পিতৃতান্ত্রিক রাজনীতি থেকে বেরিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে পারে। তবে আশঙ্কার কথা হলো, আমাদের এই আশাবাদ স্থায়ী না-ও হতে পারে। সবচেয়ে ভয়ের কথা হলো, সমাজে বড় ধরনের বিভেদ থাকায় বাংলাদেশের এই অভ্যুত্থান আরব বসন্তের মতো অল্প সময়ের মধ্যে শেষ হয়ে যেতে পারে। সবকিছু একবারে করার বিষয়ে জোরজবরদস্তি করলে অগ্রগতি আটকে যেতে পারে এবং দেশ আবার অস্থিরতা ও দমন-পীড়নের চক্রে ফিরে যেতে পারে। সেটি বাংলাদেশের ‘অত্যন্ত পিছিয়ে থাকা দেশ’ থেকে উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা পাওয়ার ভবিষ্যৎকে হুমকির মুখে ফেলবে। এ ছাড়া এই পরিস্থিতি তৈরি হলে শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ আবার শক্তি জোগাতে পারে এবং ফিরে আসতে পারে, যা দেশের কিছু সামরিক শীর্ষ নেতার গোপন স্বার্থের সঙ্গে মিলে যেতে পারে। এনসিপির বিশ্বাসযোগ্যতা ক্রমে কমে আসছে। এটি একটি সতর্কসংকেত। অন্তর্র্বতী সরকারে দুজন ছাত্র প্রতিনিধি থাকায় দলটিকে ‘কিংস পার্টি’ হিসেবে দেখা হচ্ছে। দলটি এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে নিবন্ধিত হয়নি; তা সত্ত্বেও এই দলের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ উঠছে। এ ছাড়া ‘মব জাস্টিসকে’ প্রাতিষ্ঠানিক করে তোলার এবং রাজনৈতিক সুবিধার জন্য সরকারি প্রতিষ্ঠানে বিশেষ সুবিধা নেওয়ারও অভিযোগ তাদের বিরুদ্ধে উঠেছে। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষদের সঙ্গে সহিংস সংঘর্ষ দলটির ভাবমূর্তি আরও নষ্ট করেছে। একই সঙ্গে বাড়তে থাকা অসন্তোষ অন্তর্র্বতী সরকারের মেয়াদ বাড়ানোর চেষ্টা ব্যর্থ করে দিতে পারে। গত মাসে একটি ফাইটার জেট দুর্ঘটনার পর যে ভুল ব্যবস্থাপনা দেখা গেছে, তা ইউনূসের মন্ত্রিসভার সমন্বয়ের ঘাটতিকে স্পষ্ট করে দিয়েছে। আর চলতি মাসে হাসিনার অনুপস্থিতিতে যখন তাঁর বিচার চলছে, তখন মানবাধিকার সংগঠনগুলো সরকার রাজনৈতিক বিরোধীদের হরেদরে আটক করছে বলে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। মোদ্দাকথা, অন্তর্র্বতী সরকার ২০২৬ সালের শুরুতে একটি ন্যায্য, স্বচ্ছ ও সহিংসমুক্ত জাতীয় নির্বাচন দিতে পারবে কি না, তার ওপর বাংলাদেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে। এখন সমস্যা হলো, একসময় একজোট হওয়া তরুণদের ঐক্য ক্রমেই দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। তাঁরা বিভক্ত হয়ে যাচ্ছেন। এনসিপির তরুণ নেতৃত্বকে বুঝতে হবে, অর্থপূর্ণ নীতি পরিবর্তন দীর্ঘমেয়াদি একটি প্রক্রিয়া। এ প্রক্রিয়া পরবর্তী নির্বাচনের অনেক পরেও চলবে। সংস্কারের গতি নিয়ে এনসিপি ও বিএনপির টানাপোড়েনের কারণে দেশ একধরনের ‘প্রিজনার্স ডিলেমা’ বা ‘বন্দীদের দোটানা’ দশায় পড়তে পারে। অর্থাৎ যদি তারা একে অন্যকে সহযোগিতা না করে, তাহলে দুই দলই ক্ষতির মুখে পড়বে। প্রতীকী অর্থের ‘এক দিনের গণতন্ত্র’ থেকে বেরিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে হলে বাংলাদেশের তরুণ নেতাদের উচিত ঝগড়াঝাঁটি বাদ দিয়ে গঠনমূলক সংলাপকে অগ্রাধিকার দেওয়া এবং সংস্কারের সময় ও বাস্তবায়ন নিয়ে মতবিরোধ মেটানোর চেষ্টা করা। সবকিছু একবারে করার বিষয়ে জোরজবরদস্তি করলে অগ্রগতি আটকে যেতে পারে এবং দেশ আবার অস্থিরতা ও দমন-পীড়নের চক্রে ফিরে যেতে পারে। সেটি বাংলাদেশের ‘অত্যন্ত পিছিয়ে থাকা দেশ’ থেকে উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা পাওয়ার ভবিষ্যৎকে হুমকির মুখে ফেলবে। এ ছাড়া এই পরিস্থিতি তৈরি হলে শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ আবার শক্তি জোগাতে পারে এবং ফিরে আসতে পারে, যা দেশের কিছু সামরিক শীর্ষ নেতার গোপন স্বার্থের সঙ্গে মিলে যেতে পারে। পরবর্তী নির্বাচনের ফল যা-ই হোক না কেন, হাসিনার পতন বাংলাদেশের রাজনৈতিক দৃশ্যপটকে চিরতরে বদলে দিয়েছে। কাঠামোগত সংস্কারের জন্য দেশজুড়ে যে আন্দোলন শুরু হয়েছে, তার সঙ্গে তরুণেরা এখন দৃঢ়ভাবে যুক্ত। কিন্তু তাঁরা এখন দেখতে পাচ্ছেন, একটি দমন-পীড়নমূলক শাসনব্যবস্থা গুঁড়িয়ে দেওয়া সহজ হলেও তার চেয়ে ভালো একটি শাসনব্যবস্থা গঠন করা অনেক কঠিন।




Your email address will not be published.

Comments are closed.


আজকের পত্রিকা
আজকের পত্রিকা
ফেসবুকে আমরা
পুরনো সংখ্যা
সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি রবি
 
১০
১১১২১৩১৪১৫১৬১৭
১৮১৯২০২১২২২৩২৪
২৫২৬২৭২৮২৯৩০৩১
Copyright © Dundeebarta 2024
ডান্ডিবার্তা