আজ শুক্রবার | ৩ অক্টোবর ২০২৫ | ১৮ আশ্বিন ১৪৩২ | ১০ রবিউস সানি ১৪৪৭ | রাত ৪:৩৫

জুলাই সনদ নিয়ে সৃষ্ট সংকট সমাধানের আভাস

ডান্ডিবার্তা | ০২ অক্টোবর, ২০২৫ | ৯:৩৮ পূর্বাহ্ণ

মোবায়েদুর রহমান
ক্ষমতার করিডোর থেকে যেসব পূর্বাভাস পাওয়া যাচ্ছে সেগুলো শুনে মনে হচ্ছে, জুলাই সনদের বাস্তবায়ন নিয়ে যে অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে সেটি শেষ পর্যন্ত হয়তো কেটে যাবে। ঐকমত্য কমিশনের কার্যকালের সর্বশেষ মেয়াদ ছিল ১৫ সেপ্টেম্বর। কিন্তু জুলাই সনদ বাস্তবায়ন শেষ মুহূর্তে আটকে যাওয়ায় প্রধান উপদেষ্টা স্বয়ং বিষয়টিতে হস্তক্ষেপ করেছেন। তার চূড়ান্ত লক্ষ্য হলো দেশে এমন একটি নির্বাচন অনুষ্ঠান করা যেটি হবে বিশে^ একটি রোল মডেল। তিনি আরো চান, সব দল যেন সেই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে এবং এর ফলে নির্বাচনটি যেন উৎসবমুখর হয়। আসলে জুলাই সনদ নিয়ে সৃষ্ট সংকটের সঠিক কারণ জানলে সমাধানের একটি না একটি রাস্তা বেরিয়ে আসবে বলে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস মনে করেন। সংকট সমাধানে ড. ইউনূস আন্তরিক। কিন্তু সমস্যাটি সংবিধানকেন্দ্রিক বলে বিষয়টি জটিল আকার ধারণ করেছে। এই জটিলতার গ্রন্থি খুলতে সময় লাগবে বলে ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি এবং সংস্কার কমিশনের সভাপতি ড. আলী রীয়াজ মনে করেন। সমস্যার গুরুত্ব উপলব্ধি করে ঐকমত্য কমিশনের মেয়াদ যেখানে ১৫ দিন বাড়িয়ে ৩০ সেপ্টেম্বর করার কথা ছিল সেটি আরো ১৫ দিন বাড়িয়ে এখন ১৫ অক্টোবর করা হয়েছে। সরকার মনে করছেন, এই এক মাসের মধ্যে একটি সমাধান বেরিয়ে আসবে। প্রকাশ্যে রাজনৈতিক দলসমূহের সাথে বৈঠকের খবর এবং আলোকচিত্র মানুষ দেখছেন। কিন্তু পর্দার অন্তরালে ড. আলী রীয়াজ প্রধান দুটি রাজনৈতিক দলের সাথে অনানুষ্ঠানিক সংলাপ চালিয়ে যাচ্ছেন। এ ছাড়াও বাংলাদেশে ব্যক্তিগত পর্যায়ে যারা তার সাথে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ তাদের সাথেও ড. আলী রীয়াজ আলোচনা করছেন। সর্বশেষ যে আভাস পাওয়া গেছে তাতে মনে হচ্ছে, এই জটিলতা কাটাতে এগিয়ে আসবে বিএনপি। কারণ বিএনপি মনে করে, ডাকসু এবং জাকসুতে ছাত্রদলের বিপর্যয় সত্ত্বেও আগামী জাতীয় নির্বাচনে বিএনপিই সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে। দীর্ঘ ১৭ বছর পর রাষ্ট্র ক্ষমতায় যাওয়ার সম্ভাবনা উজ্জ্বল হওয়ায় বিএনপি চাচ্ছে, যে কোনো মূল্যে সংকটের সমাধান হোক। জুলাই সংকট বাস্তবায়নের মূল বাধাটি কোথায়? সেটি হলো ৭২-এর সংবিধানের ধারাবাহিকতা সম্পর্কিত বিতর্ক। ৭২-এর সংবিধান মোতাবেকই বিএনপি জাতীয় সংসদের ৩০০টি আসনে নির্বাচন চায়। তাই বলে বিএনপি সংস্কার কমিশনের সুপারিশগুলোকে পাশ কাটাতে চায় না। জুলাই ঘোষণাপত্রের অঙ্গীকারনামায় সই করে তারা জাতির কাছে এই মর্মে ওয়াদাবদ্ধ হতে চায় যে, নির্বাচিত হওয়ার পর দুই বছরের মধ্যে তারা জাতীয় সংসদে সংস্কার কার্য সম্পন্ন করবে। ঐকমত্য কমিশনে বিএনপির প্রতিনিধিদলের নেতা সালাহউদ্দিন আহমেদ অত্যন্ত স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন যে, বর্তমান সরকার অর্থাৎ ড. ইউনূসের ইন্টারিম সরকার ৭২-এর সংবিধানের ধারাবাহিকতায় প্রতিষ্ঠিত সরকার। কারণ এই সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদ মোতাবেক সুপ্রিম কোর্ট থেকে বৈধতা নিয়েই এই সরকার গঠিত হয়েছে। সুপ্রিম কোর্ট বৈধতা দিয়েছে ডকট্রিন অব নেসেসিটি অনুযায়ী। পক্ষান্তরে, জামায়াতে ইসলামীসহ অন্যান্য দল, যারা বিএনপির এই চিন্তাধারার বিরোধিতা করছেন, তাদের বক্তব্য হলো- এই সরকার ৭২-এর সংবিধানের ধারাবাহিকতায় প্রতিষ্ঠিত সরকার নয়। এই সরকার জুলাই বিপ্লবে অংশগ্রহণকারী সারা দেশের মানুষের অভিপ্রায় মোতাবেক গঠিত সরকার। জনগণের অভিপ্রায়কে মর্যাদা দেয়ার জন্যই ছয়টি সংস্কার কমিশনের প্রস্তাব নিয়ে গত সাত মাস ধরে সরকার এবং রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আলোচনা চলছে। যদি ৭২-এর সংবিধান এই সরকারের ভিত্তি হয়ে থাকে তাহলে এত এত সংস্কারের প্রশ্ন উঠতো না। কারণ বর্তমান সংবিধানে ছয়টি সংস্কার কমিশনের ১৬৬টি সুপারিশ নিয়ে আলোচনার সুযোগ নেই। তাই তারা মনে করেন, জুলাই সনদ হবে সুপ্রিম আইন। আর আগামী নির্বাচনের আগেই জুলাই সনদকে আইনি ভিত্তি বা সাংবিধানিক স্বীকৃতি দিতে হবে। এই স্বীকৃতির পর বর্তমান সংবিধান অর্থাৎ ৭২-এর সংবিধান নয়, জুলাই সনদের ভিত্তিতে নির্বাচন অনুষ্ঠান করতে হবে। কোন পক্ষ সঠিক এবং কোন পক্ষ বেঠিক সেটি চূড়ান্ত পর্যায়ে নির্ধারণ করবেন সরকার, রাজনৈতিক দলগুলো এবং সংবিধান বিশেষজ্ঞরা। ড. আলী রীয়াজ এবং বিএনপির নির্বাচন সঠিক সময়ে অনুষ্ঠান না করার ব্যাপারে সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছেন। ড. আলী রীয়াজ বলেছেন, ফেব্রুয়ারি মাসে নির্বাচন না হলে দেশে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি হবে এবং দেশের নিরাপত্তা বিঘিœত হবে। সালাহউদ্দিন আহমেদ মনে করেন, শুধু বাংলাদেশের নিরাপত্তাই বিঘিœত হবে না, বরং আঞ্চলিক নিরাপত্তাও বিঘিœত হবে। তিনি আরো স্পষ্ট করে বলেছেন, এই অঞ্চলে দুটি বড় অ্যাক্টর আছে। আঞ্চলিক নিরাপত্তা বিপন্ন হওয়ার সাথে এই দুটি বড় শক্তি সম্পৃক্ত। বাংলাদেশ তাদের আঞ্চলিক গেমে জড়িত হতে পারে না। বড় দল হওয়ায় এবং আগামীতে ক্ষমতায় যাওয়ার সম্ভাবনায় বিএনপি এই জটিলতা দূরীকরণে যতদূর সম্ভব ছাড় দেবে বলে অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে। তারা কোন কোন পয়েন্টে ছাড় দেবে সে সম্পর্কে সরকারকে তারা একটি ইঙ্গিত দিয়ে রেখেছে। হয়তো শেষ মুহূর্তে সরকার নিজ থেকেই একটি সমাধানের ফর্মুলা দেবে যার পেছনে থাকবে বিএনপির সমর্থন। আগামী নির্বাচনে বিএনপি ভালো করবে, এমন ধারণার বশবর্তী হয়ে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল মনে করেন- আগামী ফেব্রুয়ারির নির্বাচনের আর মাত্র পাঁচ মাস বাকি। নির্বাচনের পূর্বেই বিএনপির উচিত হবে একটি বড় রাজনৈতিক দল হিসেবে তার রাজনৈতিক বয়ান বা ন্যারেটিভ অবিলম্বে নির্ধারণ করতে হবে এবং জনগণকে সেটি জানাতে হবে। বিএনপি খোলাসা করে বলুক আর নাই বলুক, জনগণ কিন্তু মনে করে- বিএনপি বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ এবং ইসলামী মূল্যবোধের ধারক। শুধু এই দুটি শব্দের মধ্যেই তাদের ন্যারেটিভ সীমাবদ্ধ থাকবে না। বিএনপিকে যদি একটি কালজয়ী রাজনৈতিক দল হতে হয় তাহলে তাকে তার রাজনৈতিক আদর্শ সঠিকভাবে ফ্রেম করতে হবে। সত্যি কথা বলতে কি, বিএনপির সঠিক পলিটিক্যাল ন্যারেটিভ আগে থেকেই ছিল। জনগণের কাছে সেই সঠিক ন্যারেটিভ দিয়েছিলেন শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান। তার রাজনৈতিক বয়ান বা ন্যারেটিভ জনগণের মনের মধ্যে লুকানো কথাকেই বাঙময় করেছিল। সেজন্যই অত্যন্ত অল্প সময়ের মধ্যে বিএনপি আওয়ামী লীগের সমকক্ষ হয়ে উঠেছিল। বেগম খালেদা জিয়াও ওই ন্যারেটিভ জনগণের কাছে সমুন্নত রেখেছিলেন বলেই আজও এই বার্ধক্যেও এবং সক্রিয় রাজনীতিতে না থাকা সত্ত্বে¡ও তিনি এখনো বিএনপি জামায়াত নির্বিশেষে সবার নিকট প্রিয় এবং অবিতর্কিত। বেগম খালেদা জিয়া জেলে যাওয়ার পর থেকেই একদিকে যেমন বিএনপির ওপর আওয়ামী লীগের জুলুমের স্টিমরোলার চেপে বসে, অন্যদিকে যে ন্যারেটিভের ওপর বিএনপি দাঁড়িয়ে ছিল সেটি যেন ধীরে ধীরে সময়ের আবর্তনে অস্বচ্ছ হতে থাকে। ওই সময় আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে জঙ্গিবাদ দমনের নামে যে ইসলাম বিরোধিতা শুরু হয় এবং আওয়ামী লীগও যেভাবে তার প্রভু ভারতকে খুশি করার জন্য বিএনপির ওপর দমননীতি চালায় তার ফলে বিএনপিকে আপাতদৃষ্টে দিকভ্রান্ত বলে মনে হয়। এর মধ্যে ১৭ বছর পার হতে চলেছে। তরুণ ও যুবসমাজের মন ও মানসিকতায় ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। তথ্যপ্রযুক্তির দ্রুত বিকাশ এখনকার তরুণ সমাজকে আগের প্রজন্মের ধ্যান-ধারণা থেকে সম্পূর্ণ বের করে এনেছে। কিছুদিন আগেও মনে করা হতো, তরুণদের মধ্যে কোনো মূল্যবোধ নাই। তারা দিন-রাত মোবাইল আর কম্পিউটার নিয়েই পড়ে থাকে। সেই সাথে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) এই প্রজন্মকে সমাজের অবশিষ্ট অংশ থেকে বিচ্ছিন্ন করেছে। কিন্তু গত জুলাই বিপ্লব সকলের চোখে আঙুল দিয়ে দেখালো যে, আমাদের তরুণ সমাজ বরং আধুনিক বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তিভিত্তিক ধর্মকে তাদের যোগ্য উত্তরাধিকার বলে মনে করেন। এসব তরুণ-তরুণীর মধ্যে পবিত্র ইসলামকে একটি শাশ্বত পূর্ণ জীবন দর্শন হিসেবে গ্রহণ করার প্রবণতা দেখা দিয়েছে। আজ থেকে ১০ বছর আগেও তরুণ সমাজ এত মসজিদমুখী ছিল না, যা আজ দেখা যাচ্ছে। তেমনি তরুণ তো বটেই, তরুণীদের মধ্যেও নামাজ আদায় করার যে প্রবণতা দেখা যাচ্ছে সেটি ১০ বছর আগেও ছিল না। পাক ভারতের খেলায় পাকিস্তান জিতলে এ দেশের তরুণ-তরুণীরা খুশি হয়। ইরানে হামলা করলে এ দেশের সর্বশ্রেণির মানুষ ইসরাইলকে ধ্বংস করতে চায়। গাজায় ইসরাইলের গণহত্যা দেখলে সাথে সাথে বাংলাদেশের তরুণ সমাজসহ সব শ্রেণির মানুষ কাশ্মীরে ভারতীয় জুলুমের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে চায়। এই বিষয়গুলো বিএনপি, মনে হয়, ভালোভাবে হৃদয়ঙ্গম করতে পারেনি। মাঝে মাঝে মনে হয়, বিএনপি উল্টোরথ যাত্রা করছে। বিএনপির নতুন ন্যারেটিভের প্রয়োজন নাই। সেই ন্যারেটিভ তো তাদের রাজনৈতিক পিতা শহীদ জিয়া দিয়ে গেছেন। মনে হচ্ছে, তার অনুসারীরা সেটা বিস্মৃত হয়েছেন। বিএনপির কিছু কিছু নেতার মুখে মৌলবাদ, সেক্যুলারিজম, দক্ষিণপন্থীর উত্থান, ইত্যাদি পরিভাষা শুনে বিএনপির সমর্থকরা বিভ্রান্ত হচ্ছেন। বিএনপি জানে না, জনগণ কিন্তু তাদের বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদী এবং ইসলামী মূল্যবোধে বিশ^াসী দল বলে এখনো মনে করতে চান। কিন্তু ইসলামের কথা মুখ ফুটে বলতে বিএনপি, মনে হয়, কুণ্ঠিত। এই কুণ্ঠা থেকে বের হতে না পারলে আগামীতে বড় রাজনৈতিক বিপর্যয় নেমে আসতে পারে। শুধু নির্বাচনের আগে নয়, ক্ষমতায় গেলেও বিএনপিকে সংস্কারমুক্ত ইসলামী মূল্যবোধের অনুসারী দল হিসেবে প্রমাণ করতে হবে। ১০০ বছর আগে ভারতে আরএসএস যে হিন্দুত্ববাদ প্রচার শুরু করেছিল, ২০১৪ সালে সেই হিন্দুত্ববাদ নরেন্দ্র মোদির আমলে ষোলো কলায় পূর্ণ হতে যাচ্ছে। প-িত নেহরুর স্বপ্নের ভারতকে তার মেয়ে ইন্দিরা, তার ছেলে রাজীব গান্ধী এবং রাজীবের পুত্র রাহুল গান্ধী হৃদয়ে ধারণ করেছেন এবং সেটি প্রচারও করে যাচ্ছেন। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর দ্বি-জাতি তত্ত্ব আজও ইমরান খানের দল, মুসলিম লীগ এবং পিপিপি হৃদয়ে ধারণ করে আছে। বাংলাদেশে মুসলিম লীগ প্রায় অস্তিত্বহীন হলেও মুসলিম লীগের অমর কীর্তি পাকিস্তান কায়েমের কথা ইতিহাস থেকে মুছে ফেলা যাবে না। বিএনপিকে হতে হবে একটি কালজয়ী রাজনৈতিক দল। আর আদর্শ ছাড়া কোনো দল সেই উচ্চতায় পৌঁছতে পারে না। ডাকসু ও জাকসুর নির্বাচন বিএনপির জন্য আই ওপেনার হওয়া উচিত। রাকসু এবং চাকসুতেও সেই ফলাফলের পুনরাবৃত্তি হতে পারে বলে অভিজ্ঞ মহল মনে করেন। তাই বিএনপিকে সময় থাকতেই তার সঠিক আদর্শের ঝান্ডা সমুন্নত করতে হবে এবং ক্ষমতায় গেলেও সেটিকে সমুন্নতই রাখতে হবে।




Your email address will not be published.

Comments are closed.


আজকের পত্রিকা
আজকের পত্রিকা
ফেসবুকে আমরা
পুরনো সংখ্যা
সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি রবি
 
১০১১১২
১৩১৪১৫১৬১৭১৮১৯
২০২১২২২৩২৪২৫২৬
২৭২৮২৯৩০৩১  
Copyright © Dundeebarta 2024
ডান্ডিবার্তা