আজ রবিবার | ১৮ মে ২০২৫ | ৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২ | ১৯ জিলকদ ১৪৪৬ | বিকাল ৩:৩৬

যে ফিলিস্তিনি সুন্দরী বিশ্বে আলোড়ন তুলেছিলেন

ডান্ডিবার্তা | ১০ এপ্রিল, ২০২৫ | ১২:৪৬ অপরাহ্ণ

ইভন রিডলি
আমি অত্যন্ত ভারাক্রান্ত হৃদয়ে এই নিবন্ধটিতে এমন একজন বিস্ময় নারীকে নিয়ে লিখছি, সাহসিকতা, নাটকীয়তা ও সংকল্পের জন্য যাঁকে বিশ্বকে অবশ্যই স্মরণ করা উচিত। তিনি লায়লা খালেদ। ১৯৭০-এর দশকে আমিসহ হাজার হাজার কিংকর্তব্যবিমূঢ় কিশোর-কিশোরীর কাছে তিনি ছিলেন অনুপ্রেরণার উৎস। ইংল্যান্ডের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের একটি শ্রমজীবী সমাজে কঠোর জীবন সংগ্রামের মধ্যে বেড়ে উঠেছিলেন লায়লা খালেদ। চেহারা ছিল খুবই হ্যাংলা-পাতলা। অনেকটা আন্ড্রæ হেপবর্নের মতো দেখতে। সে কারণেই লায়লাকে যখন একে-৪৭ হাতে নির্ভীক চেহারায় দেখা গেল, তখন বিশ্বজুড়ে অগণিত কিশোরী ও তরুণীর কল্পনায় তিনি বন্দী হয়ে গেলেন। ফিলিস্তিনি দুর্দশাকে তিনি বৈশ্বিক আলোচনার কেন্দ্রে এনেছিলেন। আমাদের মতো যাঁরা ট্যাবলয়েডের শিরোনামের বাইরে কিছু পড়তে বিরক্ত হতাম, তাঁরাই আজীবনের জন্য ফিলিস্তিনিদের ন্যায়বিচারের দাবিতে দাঁড়িয়ে ছিলাম। সে সময়ে আমি প্রথম ফিলিস্তিনিদের জন্য প্রথম একটি পিটিশনে স্বাক্ষর করেছিলাম। সত্তর দশকে স্কুলপড়ুয়াদের একটা ফ্যাশন ছিল সেনাবাহিনীর জলপাই রঙের হ্যাভারস্যাক ব্যবহার করা। জনপ্রিয় কখনো ব্যক্তিত্বের হাতে আঁকা সাদা-কালো ছবি থাকত সেসব হ্যাভারস্যাকে। ছেলেদের কাছে প্রিয় ছিলেন আর্জেন্টিনার মার্ক্সবাদী বিপ্লবী, চিকিৎসক, লেখক ও গেরিলা নেতা আর্নেস্ত চে গুয়েভারা। ১৯৬৭ সালে মৃত্যুর পর তাঁর স্টাইলিশ ছবি বিশ্বজুড়ে প্রতীক হয়ে উঠেছিল বিক্ষুব্ধ তরুণদের অভিব্যক্তি প্রকাশের উপায় হিসেবে। সুতরাং বিপ্লবী কিশোর-তরুণেরা যখন তাঁদের হ্যাভারস্যাকে চে গুয়েভারের ছবি নিয়ে ঘুরছিলেন, তখন কিশোরী ও তরুণীদের হ্যাভারস্যাকে থাকত ফুটবলার অথবা পপস্টারের ছবি। এরপর লায়লা খালেদ অধ্যায়। নারীদের মধ্যে তিনিই প্রথম উড়োজাহাজ ছিনতাই করলেন। ১৯৬৯ সালের ২৯ আগস্ট তিনি রোম থেকে তেল আবিবগামী উড়োজাহাজ ছিনতাই করেন এবং সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে বেরিয়ে যান। একই বছর কসমেটিক সার্জারি করে চেহারা পাল্টিয়ে তিনি আবার উড়োজাহাজ ছিনতাই করলেন। এবার তিনি লন্ডনে গ্রেপ্তার হলেন। যদিও একটা নাটকীয় জিম্মি বিনিময়ের সময় তিনি মুক্তি পান। এসব তিনি করেছিলেন তাঁর বয়স যখন ৩০ বছরের কম। রাজনৈতিক ও সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্যে অবরুদ্ধ পশ্চিম তীর ও গাজায় তরুণদের মধ্যে এখন ভিন্ন ধরনের বীরত্ব দেখা যাচ্ছে। সেক্যুলার বামপন্থীদের ক্ষয় হামাসের উত্থানের পথ তৈরি করেছে এবং লায়লা খালেদের মতো যেসব নারী ফিলিস্তিনিদের অধিকার আদায়ে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছিলেন, ইতিহাস থেকে তাঁদের মুছে ফেলা হয়েছে। লায়লা শুধু আবেদনময়ী ছিলেন না। তিনি আমার মতো কিশোরী, তরুণী যাঁরা নিজেদের বৈধ ও যোগ্য কারণে বিপ্লবী হিসেবে চিহ্নিত করতে চাইতেন, তাঁদের কাছে লায়লা একটা বড় আবেদন তৈরি করেছিলেন। অন্যরা তাঁদের কন্যাশিশুর নাম রেখেছিলেন লায়লা অথবা লায়লার ছবিসংবলিত টি-শার্ট পরতেন। লেখক পলা স্মিটের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে লায়লার জীবন সম্পর্কে বিস্তারিত জানা যায়। সেখানে বলা হয়েছে, ‘লায়লার জন্য একজন উদ্বাস্তুর জীবন ছিল অবজ্ঞা আর অপমানের। রেশন কার্ড ও কম্বলের জন্য অনুগতভাবে হাঁটা এবং কালাশনিকভ রাইফেল হাতে নেওয়া—এই দুটি আরোপিত বিকল্পের মধ্যে তিনি পরেরটিকে বেছে নিয়েছিলেন।’ চে গুয়েভারার মতো লায়লাও ছিলেন মার্ক্সবাদী। পপুলার ফ্রন্ট ফর দ্য লিবারেশন অব প্যালেস্টাইনের (পিইএলপি) একজন সদস্য ছিলেন তিনি। লেখক সারাহ আরভিং বলেছেন, লায়লা খালেদ যখন প্রথমবার উড়োজাহাজ ছিনতাই করেছিলেন, তখন পপুলার ফ্রন্ট ফর দ্য লিবারেশন অব প্যালেস্টাইন ছিল একটি বামপন্থী সংগঠন। আন্তর্জাতিকভাবে অন্য বামপন্থীদের সঙ্গে এই তাদের যোগসূত্র ছিল। জেরুজালেমের দেয়ালে প্রতিরোধের প্রতীক হিসেবে আঁকা লায়লা খালেদের ছবি। এই সংগঠনটি ২০ বছর আগে নিজ জন্মভূমি থেকে উচ্ছেদ হওয়া ফিলিস্তিনিদের তাদের জন্মভূমিতে ফিরিয়ে নেওয়ার সংগ্রামে বিজয়ী হবে বলে ঘোষণা করেছিল। সেটা ছিল চে গুয়েভারার যুগ, মাত্র দুই বছর আগে বলিভিয়ার জঙ্গলে তিনি নিহত হয়েছিলেন। সেটা ছিল দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার স্বাধীনতাসংগ্রামের যুগ। বিশ্বজুড়েই তখন নিপীড়িত মানুষের অধিকার আদায়ে সশস্ত্র সংগ্রামের কথা আলোচিত হয়েছিল। আর এই সব সংগ্রামের নায়কদের ছবি শিক্ষার্থীদের শোবার ঘরে এবং বামপন্থীদের বাড়িতে স্থান পেয়েছিল। নারীবাদী আন্দোলনের দ্বিতীয় ঢেউও সে সময়ে ভেঙে পড়ছিল, সেটা আরেক ধরনের আবহ তৈরি করেছিল এবং সেই আবহে একজন তরুণীর উড়োজাহাজ ছিনতাইয়ের খবরটিকে বিবেচনা করতে হবে। ফিলিস্তিনি ক্যাফায়া পরিহিত এবং একে-৪৭ হাতে লায়লা খালেদের নাটকীয় ছবি ফিলিস্তিনি সশস্ত্র প্রতিরোধ আন্দোলনের মুখ হয়ে উঠেছিল। আজকের মধ্যপ্রাচ্যের দিকে তাকালে আমি তাঁর সাহস ও বীরত্বের প্রতি বিস্ময়ভরা চোখে তাকিয়ে থাকি। কেননা ফিলিস্তিনের বাইরে এ রকম বীরত্ব ও সাহসের ঘাটতি রয়েছে। রাজনৈতিক ও সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্যে অবরুদ্ধ পশ্চিম তীর ও গাজায় তরুণদের মধ্যে এখন ভিন্ন ধরনের বীরত্ব দেখা যাচ্ছে। সেক্যুলার বামপন্থীদের ক্ষয় হামাসের উত্থানের পথ তৈরি করেছে এবং লায়লা খালেদের মতো যেসব নারী ফিলিস্তিনিদের অধিকার আদায়ে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছিলেন, ইতিহাস থেকে তাঁদের মুছে ফেলা হয়েছে। আমাদের অবশ্যই এই প্রবণতাটি পাল্টে দিতে হবে। ৮০ বছর বয়সী লায়লা খালেদ এখন জর্ডানে তাঁর বাড়িতে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণের কারণে চরম অসুস্থতার মধ্যে দিন পার করছেন। আমার এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই যে আরব বিশ্ব ও রামাল্লার ক্ষমতায় থাকা লোকদের উদ্যোমহীনতা লায়লা খালেদকে চরমভাবে হতাশ করেছিল। তিনি যদি কম বয়সী বিপ্লবী হতেন, তাহলে সম্ভবত তিনি তাঁর বন্দুকটি আবার তুলে নিতেন।
ইভন রিডলি ব্রিটিশ সাংবাদিক ও লেখক




Your email address will not be published.

Comments are closed.


আজকের পত্রিকা
আজকের পত্রিকা
ফেসবুকে আমরা
পুরনো সংখ্যা
সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি রবি
 
১০১১
১২১৩১৪১৫১৬১৭১৮
১৯২০২১২২২৩২৪২৫
২৬২৭২৮২৯৩০৩১  
Copyright © Dundeebarta 2024
ডান্ডিবার্তা