আজ রবিবার | ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫ | ১৩ আশ্বিন ১৪৩২ | ৫ রবিউস সানি ১৪৪৭ | রাত ৩:৪৯

নিষিদ্ধ ভূমি’ হতে আর কত দেরি?

ডান্ডিবার্তা | ২৭ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ | ৬:৫৫ পূর্বাহ্ণ

জোবাইদা নাসরীন
বাংলাদেশ কি ধীরে ধীরে এক ‘নিষিদ্ধ ভূমি’তে পরিণত হতে যাচ্ছে? যেখানে মানুষের চুলের দৈর্ঘ্য থেকে শুরু করে গানের সুর, মেলার রং, এমনকি কোন পোশাক পরবেন, সে জন্য কারও কারও অনুমোদনের প্রয়োজন হয়ে পড়বে? সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেইসবুকে একটি ভিডিও ঘুরে বেড়াচ্ছে—সেখানে দেখা যাচ্ছে রাস্তায় জটাধারী একজন মধ্যবয়স্ক লোককে ধরে তার মাথার চুল কেটে দিচ্ছে কয়েকজন। নিরূপায় লোকটি, ‘আল্লাহ তুই দেহিছ’ বলে যখন বিচার চাচ্ছেন—তা আমাদের চোখে শুধু এক ব্যক্তির অপমান নয়, বরং এক সমষ্টিগত ভয়ের প্রতিচ্ছবি তুলে ধরেছে। ধর্মের দোহাই দিয়ে, শুদ্ধতার নামে, সামাজিক শৃঙ্খলা রক্ষার কথা বলে মব যখন হাত বাড়ায়, তখন তা আসলে সংস্কৃতি, স্বাধীনতা আর নাগরিক অধিকারের মূলে আঘাত হানে। নিষেধাজ্ঞার এই শেকল যত দীর্ঘ হচ্ছে, ততই বাংলাদেশের মানুষ যেন ‘নিজ বাসভূমে পরবাসী’ হয়ে যাচ্ছে। এ ধরনের ঘটনা এর আগেও দেখা গেছে। তবে অন্তর্র্বতী সরকারের আমলে এগুলো লাগামছাড়া হয়ে পড়েছে। এর উদ্দেশ্য হলো একটা ভয়ের পরিবেশ জিইয়ে রাখা এবং অন্যরাও যেন মনে করে তারা বড় চুল রাখলেই তাদের এই ধরনের হেনস্তা করা হবে। এর মধ্য দিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠের ধর্মের মতাদর্শিক আধিপত‍্য বিস্তারেরও চেষ্টা চলছে। নানান ধরনের নিষেধাজ্ঞা রাজনীতি বেশ জোরোশোরেই আগাচ্ছে এবং মবকারীদের ‘প্রেশার গ্রুপ’ আখ্যা দিয়ে আশকারা দেওয়া হচ্ছে। এখনকার ধরন এবং বৈশিষ্ট্য একই ধরনের এবং একই গোষ্ঠী করছে সুপরিকল্পিতভাবে। অধিকাংশ ঘটনায় মববাহিনী নিজেদের ‘তৌদিহী জনতা’ বলে দাবি করে একের পর পর এক নিষেধাজ্ঞার ঝুনঝুনি বাজিয়ে যাচ্ছে। আবার সুযোগ বোঝে এই নিষেধাজ্ঞার রাজনীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদকারীদের ‘ফ‍্যাসিস্টের দোসর’ তকমা দিয়ে নয়া ফ্যাসিজিম চালু রাখছে। পাছে অন্য কেউ এটির প্রতিবাদ করতে গেলেই তাকে ‘ফ‍্যাসিস্ট’ কালি মাখতে হবে বা গালি খেতে হবে। তাই প্রতিবাদ, প্রতিরোধহীন নিষেধাজ্ঞা ক্রমশই এর কলেবর বাড়াচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে অন্তর্বতী সরকার দেশের সব প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সংগীত শিক্ষক নিয়োগের যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তার শুধু কঠোর সমালোচনা করেই চুপচাপ থাকেনি জামায়াতে ইসলামীসহ ধর্মভিত্তিক পাঁচটি দলের নেতারা। তাদের দাবি দৃশ্যত একটি হলেও এর ভেতরে আরেকটি দাবি লুকায়িত আছে। প্রথমটি হলো সংগীতের শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া যাবে না এবং অন্যটি এর বিপরীতে ধর্মীয় শিক্ষক নিয়োগ দিতে হবে। তারা আরও হুঙ্কার দিয়েছেন এই বলে যে, ‘এর ব্যতিক্রম হলে দেশের ইসলামপ্রেমিক জনগণ রাজপথে নামতে বাধ্য হবেন।’ গানের শিক্ষক নিয়োগের প্রজ্ঞাপন বাতিলের দাবি করেছেন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের জ্যেষ্ঠ নায়েবে আমির মুহাম্মাদ ফয়জুল করীম। তিনি এই অবস্থানের প্রতি আরও জোর দিয়ে বলেছেন, ‘কোনো অবস্থাতেই গানের শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া যাবে না।’ তিনি অন্তর্র্বতী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার প্রতি হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন, ‘যদি বাংলাদেশের প্রাইমারি লেভেলে গানের শিক্ষক নিয়োগের দুঃসাহস দেখান, তাহলে বাংলাদেশের জনগণ ঐক্যবদ্ধভাবে আপনাকে জবাব দেবে।’ প্রজ্ঞাপন বাতিলের দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করেছে জাতীয় ওলামা-মাশায়েখ আইম্মা পরিষদ। যদিও অনেক আগ থেকেই প্রাথমিক এবং মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ধর্মীয় শিক্ষক রয়েছেন। সেটি কী তারা জানেন না? নাকি আরও বেশি ধর্মীয় শিক্ষক নিয়োগের জন্য এই দাবি করছেন? বিভিন্ন সংগঠন এবং ব্যক্তিবর্গ বিচ্ছিন্নভাবে বিবৃতি দিয়ে এর প্রতিবাদ করেছেন। তবে গত এক বছরে এই ধরনের নিষেধাজ্ঞা জড়ানো আবদার কয়েকবারই আলোচনায় এসেছে। শুধু বলেই ক্ষ্যান্ত নয়, বরং ধর্মকে ব্যবহার করে এই ধরনের নিষেধাজ্ঞার পাশাপাশি সেটি প্রয়োগ করতে মব সৃষ্টি করে হামলা এবং প্রাণহানির ঘটনা ঘটানো হয়েছে। অন্তর্র্বতী সরকারের গঠিত হওয়ার পর থেকে এক বছরেরও বেশি সময় ধরে মব বাহিনী বিভিন্ন জায়গায় গানের অনুষ্ঠান, সামা কাওয়ালি, ওরশ বন্ধ করে দেওয়ার হুমকি দেওয়া মাত্রই আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী মব প্রতিরোধ না করে অনুষ্ঠানগুলোই বন্ধ করে দিয়ে উল্টো উৎসাহ দিয়েছে। ময়মনসিংহ শহরের প্রাণকেন্দ্রে হজরত শাহ সুফি সৈয়দ কালু শাহর মাজারে মিলাদ মাহফিল, দোয়া ও সামা কাওয়ালি অনুষ্ঠানে হামলা করে বন্ধ করে দেওয়া হয়। এরপর গভীর রাতে কয়েকশ মাদ্রাসাছাত্র গিয়ে হামলা চালিয়ে ২০০ বছরের পুরোনো মাজারটির একটি অংশও ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয়। ২০২৪ সালের ২৫ নভেম্বর যশোরের মনিরামপুর উপজেলায় বাউলসম্রাট সুফিসাধক ফকির লালন শাহর স্মরণে গত ১২ বছর ধরে আয়োজিত সাধুসংঘ ও বাউল গানের আসরে হামলা চালানো হয়। এ বছর ছিল ১৩তম সাধুসংঘ ও বাউল গানের আসর। সেখানে হামলা চালিয়ে গানের আসর বন্ধ করে দেওয়ার অভিযোগ সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছিল। গত জানুয়ারি মাসে বাউলচর্চা কেন্দ্রে সিদ্ধিরগঞ্জ থানার ওসি ফোর্সসহ এসে শুধু গানই বন্ধ করেননি, বরং ঢোল, হারমোনিয়াম, প্যাড, ড্রামও নিয়ে যান। এই ঘটনার কিছুদিন আগেই হেফাজতে ইসলামের আপত্তির মুখে নারায়ণগঞ্জেই লালন মেলা বন্ধ করে দেওয়া হয়। ‘অনৈসলামিক’ আখ্যা দিয়ে টাঙ্গাইলের সখীপুর উপজেলার ৭৫ বছর পুরনো ফাইলা পাগলার মেলা বন্ধ ঘোষণা করে দিয়েছিল যৌথবাহিনী। মব বাহিনী আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারীদের সহযোগিতাপূর্ণ ভূমিকায় উৎসাহিত হয়েছে। এত গেল মাজার, দরগা, ফকির ও বাউলদের ওপর চেপে বসা থাকা খড়্‌গের কথা। তাদের অনেকেই শারীরিকভাবে যেমন আক্রান্ত হয়েছেন, তেমনি হয়েছেন অসম্মানিত। সামাজিক ও সংবাদমাধ্যমে সূত্রে প্রাপ্ত খবর থেকে জানা যায় যে, গত এক বছরে মবের কারণে তিনশোর অধিক গানের অনুষ্ঠান বাতিল করতে হয়েছে। আক্রান্ত হয়েছে একশোরও বেশি মাজার। অনেক মাজারেই নিষিদ্ধ ঘোষণা করে গান-বাজনা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। গানের পাশাপাশি আরও নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে বিভিন্ন ক্ষেত্রে। ‘অনৈসলামিক’, ‘ধর্মীয় অবমাননা’ কিংবা ‘ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত’-এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ‘ফ্যাসিস্ট’ কিংবা ‘ফ্যাসিবাদের দোসরের’ মতো ঝটিকা তকমা। এই তকমা প্রদানের একমাত্র উদ্দেশ্য হলো নিপীড়নকে বৈধ করা। যার কারণে আমরা দেখেছি স্রোত আবৃত্তি সংসদের ‘রবীন্দ্র স্মরণ–দ্রোহে, জাগরণে রবীন্দ্রনাথ’ শীর্ষক কবিতা আবৃত্তির অনুষ্ঠান বাতিল হয়েছে ‘ফ্যাসিবাদবিরোধী সাংস্কৃতিক মৈত্রী’ নামে একটি সংগঠনের তদারকিতে। কারা এই সংগঠনের মূল নেতৃত্বে রয়েছেন? কাকে ঠেকানোর জন্য তারা কার সঙ্গে মৈত্রী করতে মব তৈরি করছেন? শুধু গান-বাজনা, নাচ কিংবা আঁকাআঁকিতেই নয়, নিষেধাজ্ঞার ঝাপটা তেড়ে আসছে বিভিন্ন স্তরে। আগে নারীর পোশাকের দৈর্ঘ্য, প্রস্থ এবং ওড়নার আবরণ মাপা-যাচাই হলেও এখন রেহাই পাচ্ছে না ছেলেরাও। সাম্প্রতিক সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টারদা সূর্যসেন হলের নব-নির্বাচিত ভিপির এক ধরনের নির্দেশ ছিল ‘ক্যান্টিন বয় হাফ প্যান্ট পড়ে ক্যান্টিনে কাজ করতে পারবে না’। এর আগে আমরা দেখেছি কোন কোন ইসলামি দল পাবলিক পরিসরে নারীর বিরুদ্ধে গালি-গালাজ করেছে, নারীবিদ্বেষী বক্তব্য দিয়েছে। বিভিন্ন বিষয়ে নিয়ে তাদের মতামতের আদলে আসলে তারা এক ধরনের নিষেধাজ্ঞার প্রতি ইঙ্গিত দিয়ে যাচ্ছে। আবার কোন কোন ক্ষেত্রে কোন কোন ইসলামি দলের নেতারা অন্য দলের নেতা-কর্মীদেরও এই মবে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য পেছন থেকে উৎসাহ এবং পরামর্শ দিয়েছেন। যার কারণে সংবাদমাধ্যমে হয়তো দৃশ্যমান হয়েছে প্রতিদ্বন্দ্বী দলের স্থানীয় নেতারা। পিছিয়ে নেই সরকারও। এই ধরনের ঘটনার বিচার করা তো দূরের কথা, বরং স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা দুর্গাপূজা উপলক্ষে বেশ কিছু বিধি-নিষেধ এবং বাধ্যবাধকতার কথা বলেছেন। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য— ‘মদ’ না খাওয়ার পরামর্শ। ‘মদ’ খাওয়ার প্রসঙ্গ টেনে এনে সেখানে মেলা বন্ধের ইঙ্গিত এবং প্রতিমা বিসর্জনের সময়সূচিও নির্ধারণ করে দিয়েছেন। যদিও এখানে ‘ধর্মীয় অবমাননার’ রশিটি কেউই সামনে ঝুলাননি। আর সংখ্যালঘুরাও বুঝে গেছেন ‘ধর্মীয় অবমাননা’ এদেশের মুসলিমদেরই একতরফা সম্পত্তি। এখানে কাউকেই ভাগ দেওয়া যাবে না। এই নিষেধাজ্ঞা এবং নিপীড়নের রাজনীতির পেছনে যেমন রয়েছে একক নিয়ন্ত্রণ এবং কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষা, অন্যদিকে প্রতিপক্ষকে হেনস্তা করে, কিংবা কখনও কখনও তাদের দিয়ে মব করিয়ে রাজনৈতিক সুবিধা নেওয়ার তাগিদ। কাউকে কিছু করতে বাধ্য করা কিংবা নিপীড়ন করা ফৌজদারী অপরাধ। শুরুতে যে ভিডিওটির কথা বলছিলাম, সেটিতে দেখা যাচ্ছে জোর করে বৃদ্ধের চুল কেটে দেওয়া তিনজনের মধ্যে দুইজনের গায়ে একই রকম পোশাক; এমনকি কোটও একই ধরনের। তারা প্রকাশ্যেই এসব কর্মকা- করছেন। তার মানে তারা জানেন যে কেউই তাদের কিছু করতে পারবে না। কেউ কেউ তো রীতিমতন ফেইসবুকে পেইজ বানিয়ে নিজেরা এগুলোকে ভালো কাজ নাম দিয়ে প্রচার করছেন। তাহলে সরকার বাহাদুর কী করবেন? ‘নিষেধাজ্ঞা’, ‘করা যাবে না’, ‘করতে পারবে না’ — এগুলোর মালাই জনগণকে পরাতে থাকবেন? নাকি পুরো বাংলাদেশকেই এক ‘নিষিদ্ধ ভূমি’ হিসেবে হাজির করার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখবেন?




Your email address will not be published.

Comments are closed.


আজকের পত্রিকা
আজকের পত্রিকা
ফেসবুকে আমরা
পুরনো সংখ্যা
Copyright © Dundeebarta 2024
ডান্ডিবার্তা