আজ শুক্রবার | ১১ জুলাই ২০২৫ | ২৭ আষাঢ় ১৪৩২ | ১৫ মহর্‌রম ১৪৪৭ | বিকাল ৩:৫৬

মাহাথিরের শত বছর

ডান্ডিবার্তা | ১১ জুলাই, ২০২৫ | ১২:১৩ অপরাহ্ণ

ডান্ডিবার্তা রিপোর্ট
মানবজীবন দীর্ঘ হতেই পারে। কিন্তু সব দীর্ঘজীবনই মহিমান্বিত হয় না। দীর্ঘ সে জীবন যদি ত্যাগ স্বীকারের হয়, অপরের কল্যাণে হয়, তবে সে জীবন একই সঙ্গে হয় সফল।
দীর্ঘ ও সফল জীবনের এক উদাহরণ ড. মাহাথির মোহাম্মদ। তাঁকে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার কিছু নেই। আধুনিক মালয়েশিয়ার স্থপতি, যিনি প্রথম দফায় (১৯৮১-২০০৩) দীর্ঘ ২২ বছর সফলভাবে দেশটির নেতৃত্ব দিয়েছেন। মালয়েশিয়াকে করেছেন একটি আধুনিক ও সমৃদ্ধিশালী রাষ্ট্র।
ড. মাহাথির চল্লিশের দশকে সিঙ্গাপুরে চিকিৎসাশাস্ত্রে পড়াশোনা করেন। সেখানে তাঁর সঙ্গে পরিচয় হয় সিতি হাসমাহর। পরিচয় থেকে অন্তরঙ্গতা, এরপর বিয়ে। সিতি হাসমাহও ওই মেডিকেলেরই শিক্ষার্থী ছিলেন।
দ্বিতীয় দফায় (২০১৮-২০২০) রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে আসেন ৯৪ বছর বয়সে। তাঁর কর্মস্পৃহা, উদ্যম রীতিমতো তাক লাগিয়ে দেওয়ার মতো। এখন ১০০ বছর বয়সেও প্রায় সুস্থ জীবন যাপন করছেন মাহাথির।
২০২৩ সালে ঢাকার বাংলা একাডেমির সবুজ চত্বরে হয়ে যাওয়া লিট ফেস্টে একটি সেশনে আমন্ত্রিত অতিথি ছিলেন মাহাথিরকন্যা মেরিনা মাহাথির। তিনি একজন সুপরিচিত মানবাধিকারকর্মী ও লেখক। মাহাথিরকে নিয়ে তাঁর লেখা বই ‘দ্য অ্যাপল অ্যান্ড দ্য ট্রি’ নিয়েই মূলত আলোচনা হচ্ছিল। সেখানে মানবাধিকারসহ অন্যান্য বিষয়ের পাশাপাশি ছোট্ট করে উঠে এল মাহাথিরের দীর্ঘ জীবনের প্রসঙ্গও।
সেই জায়গা থেকেই এ লেখার অনুপ্রেরণা। আসলেই তো! মাহাথিরের দীর্ঘ ও সফল জীবনের প্রকৃত রহস্যটা কী?
মাহাথিরের রাজনৈতিক জীবন, বিরোধী মত দমন, মানবাধিকার রক্ষা নিয়ে তাঁর সীমিত অঙ্গীকার—এসব নিয়ে কম আলোচনা, তর্কবিতর্ক হয়নি। এখনো হচ্ছে। পাশাপাশি তাঁর জীবনবোধ, একনিষ্ঠতা, নিয়মানুবর্তিতা, শৃঙ্খলাও আলোচনায় এসেছে।
কিন্তু যে মানুষ শত বছর বয়সেও কর্মক্ষম থাকেন, সেই মানুষটি ভিন্ন।
মাহাথিরের জীবনের পাÐুলিপি
মাহাথিরের জীবনের পাÐুলিপিতে চোখ বুলিয়ে আসা যাক। জন্ম মালয়েশিয়ার কেদাহ রাজ্যের প্রধান শহর আলোর সেতারে। তাঁর দাদা ভারতের কেরালা থেকে সেখানে অভিবাসী হন। বিয়ে করেন এক মালয় নারীকে।
ছোটবেলা থেকেই তুখোড় মেধাবী ছিলেন মাহাথির। বাবা মোহাম্মদ ইস্কান্দার, যিনি ছিলেন একটি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের প্রধান শিক্ষক, শৈশবেই ছেলের মধ্যে শৃঙ্খলা ও একাগ্রতার বীজ বপন করে দিয়েছিলেন। পড়াশোনা করতে গিয়ে তাই খেলাধুলায় মনোযোগ দিতে পারেননি মাহাথির।
ড. মাহাথির চল্লিশের দশকে সিঙ্গাপুরে চিকিৎসাশাস্ত্রে পড়াশোনা করেন। সেখানে তাঁর সঙ্গে পরিচয় হয় সিতি হাসমাহর। পরিচয় থেকে অন্তরঙ্গতা, এরপর বিয়ে। সিতি হাসমাহও ওই মেডিকেলেরই শিক্ষার্থী ছিলেন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে মেডিকেল কলেজ বন্ধ থাকে। এ সময় মাহাথির কফি, চকলেট বিক্রি করে কিছু উপার্জন করেন। ১০০তম জন্মদিনের অনুষ্ঠানে কেক কাটছেন মাহাথির মোহাম্মদছবি: ফেসবুক থেকে
গাইনোকোলজিতে এমবিবিএস শেষ করে সরকারি চাকরিতে যোগ দেন মাহাথির। পাশাপাশি নিজ অঞ্চল কেদাহর আলোর সেতারে ফিরে চিকিৎসাসেবা শুরু করেন। সে সময় আলোর সেতারে একমাত্র চেম্বারটি ছিল মাহাথিরের। একসময় তাঁর মধ্যে ধারণা আসে, ডাক্তারি পেশা দিয়ে সীমিতসংখ্যক মানুষের উপকারে আসা সম্ভব। কিন্তু বিপুল মানুষের সেবা করতে হলে রাজনীতির বিকল্প নেই। সেই চিন্তা থেকে রাজনীতির ময়দানে পা ফেলেন ১৯৬৪ সালে, তখন তাঁর বয়স ৪০-এর কাছাকাছি।
মাহাথির-সিতি দম্পতির এক মেয়ে, চার ছেলে। মেরিনা পরিবারের বড় সন্তান। পরে অবশ্য তাঁরা আরও দুটি সন্তান দত্তক নেন।
১৯৮১ সালে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার আগে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও দপ্তর সামলেছেন মাহাথির। নির্ধারিত সময়ের আগেই নিজ দপ্তরে পৌঁছে যান তিনি। এক মিনিট দেরির রেকর্ড তাঁর নেই। এ নিয়ে অনেক গল্প প্রচলিত আছে।
নিজেকে নিয়ন্ত্রণ জরুরি
ছাত্রজীবন থেকে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করা মানুষ মাহাথির। তাঁর একটি প্রিয় কথা হলো, ‘আমাদের বাঁচার জন্য খাওয়া উচিত। খাওয়ার জন্য বাঁচা উচিত নয়। যেটুকু প্রয়োজন, এর বেশি খাওয়া একেবারেই উচিত নয়।’
তাঁর পরামর্শ, স্থূলতা স্বাস্থ্যের পক্ষে ভালো নয়। কেউ বেশি দিন যদি বাঁচার আশা করেন, তবে তাঁকে শরীর থেকে বাড়তি মেদ ঝরিয়ে ফেলতে হবে।
শরীরের চাহিদার চেয়ে খাবার বেশি গ্রহণ করা হচ্ছে কি না, সেটা একজন মানুষ কীভাবে বুঝবে? এ বিষয়ে মাহাথির বলেছেন, কারও কোমরের চারপাশে যদি ফ্যাট বা চর্বি জমে যায়, তবে বুঝবেন, তিনি প্রয়োজনের অতিরিক্ত খাবার গ্রহণ করছেন। তখন তাঁকে প্লেটের খাবার চার ভাগের এক ভাগে বা তিন ভাগের এক ভাগে নামিয়ে আনতে হবে।
নিউ স্ট্রেইট টাইমস পত্রিকায় এক কলামে মাহাথির লিখেছেন, শর্করা (ভাত) ও চর্বিজাতীয় খাবার এড়িয়ে চলতে হবে। তাহলে কোমরের চারপাশের চর্বি কমতে শুরু করবে।
খাদ্যনিয়ন্ত্রণের মাধ্যমেই মালয়েশিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী তাঁর ওজন ৩৫ বছর ধরে ৬২ থেকে ৬৪-এর মধ্যে বেঁধে রাখতে পেরেছেন। এমনিতে মালয়েশিয়া স্থূল মানুষের দেশ হিসেবে এশিয়ায় পরিচিত। দেশটির অর্ধেক মানুষের ওজন বেশি অথবা স্থূল। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, গত দুই দশকে এ প্রবণতা আরও বেড়েছে।
নারকেলের তেল দিয়ে ব্যঞ্জন সেখানে খুব জনপ্রিয়। আর ফাস্ট ফুডের জনপ্রিয়তা দিন দিন বাড়ছে। মাহাথিরের কথায়, খাবার যখন স্বাদের হয়, তখন খাওয়া বেশি হয়। এতে পাকস্থলী দিন দিন স্ফীত হতে থাকে। তখন একে বশে রাখতে আরও খাবারের চাহিদা তৈরি হয়। অতিরিক্ত খাবারের কারণে ধীরে ধীরে লিভার, কিডনি, প্যানক্রিয়াসের ওপর চাপ পড়ে। উচ্চ রক্তচাপ ও হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি তৈরি হয়।
২০০৭ সালে মাহাথিরের নিজেরও দুবার হার্ট অ্যাটাক হয়। ওই বছর ১০ মাসের মধ্যে দুবার হৃদ্‌রোগে আক্রান্ত হন তিনি। তাঁর বাইপাস সার্জারি হয়। তিনি পুরোপুরি সুস্থ হয়ে ওঠেন।
গ্রিল করা মহিষের মাংস তেঁতুলের সস দিয়ে খেতে খুব পছন্দ করেন মাহাথির। এ ছাড়া মুরগির মাংস দিয়ে চ্যাপটা রুটি (রোটি চেনাই) তাঁর আরেকটি প্রিয় খাবার। মাছ খেতে তেমন একটা পছন্দ করেন না। এমনিতে মালয়েশিয়া স্থূল মানুষের দেশ হিসেবে এশিয়ায় পরিচিত। দেশটির অর্ধেক মানুষের ওজন বেশি অথবা স্থূল। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, গত দুই দশকে এ প্রবণতা আরও বেড়েছে।
নারকেলের তেল দিয়ে ব্যঞ্জন সেখানে খুব জনপ্রিয়। আর ফাস্ট ফুডের জনপ্রিয়তা দিন দিন বাড়ছে। মাহাথিরের কথায়, খাবার যখন স্বাদের হয়, তখন খাওয়া বেশি হয়। এতে পাকস্থলী দিন দিন স্ফীত হতে থাকে। তখন একে বশে রাখতে আরও খাবারের চাহিদা তৈরি হয়। অতিরিক্ত খাবারের কারণে ধীরে ধীরে লিভার, কিডনি, প্যানক্রিয়াসের ওপর চাপ পড়ে। উচ্চ রক্তচাপ ও হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি তৈরি হয়।
২০০৭ সালে মাহাথিরের নিজেরও দুবার হার্ট অ্যাটাক হয়। ওই বছর ১০ মাসের মধ্যে দুবার হৃদ্‌রোগে আক্রান্ত হন তিনি। তাঁর বাইপাস সার্জারি হয়। তিনি পুরোপুরি সুস্থ হয়ে ওঠেন।
গ্রিল করা মহিষের মাংস তেঁতুলের সস দিয়ে খেতে খুব পছন্দ করেন মাহাথির। এ ছাড়া মুরগির মাংস দিয়ে চ্যাপটা রুটি (রোটি চেনাই) তাঁর আরেকটি প্রিয় খাবার। মাছ খেতে তেমন একটা পছন্দ করেন না।
মাহাথিরের পরামর্শ
যাঁদের বয়স ৬০ পেরিয়েছে বা যাঁরা অবসরজীবন যাপন করছেন, তাঁদের জন্য মাহাথিরের পরামর্শ হলো, সব সময় সক্রিয় থাকার চেষ্টা করতে হবে। হাঁটতে হবে, শরীরচর্চা করতে হবে। বয়স্কদের দীর্ঘ সময় ঘুমিয়ে থাকার পক্ষে নন মাহাথির, বিশেষ করে দিনের বেলায়। তিনি যেমন এই বয়সেও সকালে কাজ শুরু করে শেষ করেন রাত ১০টা বা ১১টায়।
সব মিলে প্রতিদিন সাত ঘণ্টা ঘুমানোর চেষ্টা করেন মাহাথির। তাঁর মতে, এর বেশি ঘুমালে শরীর দুর্বল হয়ে পড়ে। একটু কম ঘুমের পাশাপাশি যদি শরীরচর্চা করা যায়, তবে মাংসপেশি ও হাড় শক্তিশালী থাকে। এতে ব্রেনও সক্রিয় থাকে।
মাহাথিরের পরামর্শ, ব্রেনকে যদি কাজে লাগানো না হয়, তবে সে-ও হাল ছেড়ে দেবে, নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়বে। ব্রেনের পতন ঠেকাতে সক্রিয় থাকতে হবে, কথা বলতে হবে, বই পড়তে হবে, লিখতে হবে, সমস্যার সমাধান করতে হবে, যুক্তি দিতে হবে, বিতর্ক করতে হবে। যাঁরা এ কাজগুলো করেন না, তাঁরা ব্রেনের প্রধান প্রধান কাজ থেকে নিজেদের বিরত রাখেন। মাহাথির বলেন, তাঁর এ অভিমত কোনো বৈজ্ঞানিক গবেষণার আলোকে নয়, কেবলই তাঁর নিজস্ব অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে।
মাহাথির মনে করেন, সংবাদ বা খবরের মধ্যে থাকা মানসিক মনোবল বৃদ্ধির একটা উপায়। তাঁর মতে, প্রতিদিন সংবাদপত্র পাঠ মনকে সক্রিয় রাখতে সহায়তা করে। একজন বয়স্ক মানুষ সাধারণত বর্তমানের চেয়ে অতীতে স্মৃতিচারণায় বেশি আগ্রহী হন। সংবাদপত্র ও বই পাঠ করা এবং কথা বলার মধ্য দিয়ে এ ক্ষেত্রে তাঁদের উন্নতি হয়। মাহাথিরের মতে, ব্রেনকে সক্রিয় ও সুস্থ রাখার আরেকটি উপায় হলো লেখালেখি করা। মালয়েশিয়ার চতুর্থ ও সপ্তম এই প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘লেখালেখি আপনার ব্রেনকে সব সময় সক্রিয় রাখতে সাহায্য করবে। সাধারণত আপনি এমন কিছু লিখতে চান, যা পাঠযোগ্য, অন্যরা পছন্দ করবে। এমন কিছু লিখতে গেলে আপনাকে কথা বলতে হবে, চিন্তা করতে হবে, তর্ক করতে হবে এবং নিজের সঙ্গে প্রয়োজনে ঝগড়াও করতে হবে।’
মাহাথির নিজেও লেখালেখি করতে পছন্দ করেন। মেডিকেলের ছাত্র থাকার সময় থেকেই লেখালেখি করছেন। তাঁর একটি ছদ্মনাম রয়েছে—‘ছেদেত’। ছাত্রজীবন থেকেই এই ছদ্মনামে সংবাদপত্রে কলাম লিখছেন তিনি। এই নামে তাঁর একটি বøগও রয়েছে। মালয় ও ইংরেজি—দুই ভাষাতেই সেখানে লেখালেখি করেন মাহাথির। ওই সাইটের ভিউর সংখ্যা তিন কোটির ওপরে, যা কেবল বাড়ছেই।
ধূমপান ও অ্যালকোহল থেকে ১০০ হাত দূরে থাকেন ইসলাম ধর্মের একনিষ্ঠ অনুসারী মাহাথির। কখনো তিনি কুঁজো হয়ে বা বাঁকা হয়ে দাঁড়ান না, বসেন না, একজন সামরিক অফিসারের মতো সোজা হয়ে বসেন, সোজা হয়ে দাঁড়ান। সুস্থভাবে বেঁচে থাকার জন্য মাহাথির বিশেষ কোনো ডায়েট চার্ট দিতে চান না। তাঁর মতে, শর্করা (ভাত, রুটি) কম খেতে হবে। শাকসবজি, মৌসুমি ফলমূল বেশি খেতে হবে। এটুকু মানলেই যথেষ্ট।
মাহাথিরের মতে, দীর্ঘদিন বাঁচা একটা বিষয়। আর দীর্ঘদিন সুস্থভাবে বাঁচা আরেকটা বিষয়। তিনি বলেন, ‘সবকিছু আমাদের হাতের মধ্যে নেই, কিন্তু যেটুকু আছে, সেটুকু মেনে চললে বুড়ো বয়সেও সুস্থ থাকা যায়।’

 




Your email address will not be published.

Comments are closed.


আজকের পত্রিকা
আজকের পত্রিকা
ফেসবুকে আমরা
পুরনো সংখ্যা
সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি রবি
 
১০১১১২১৩
১৪১৫১৬১৭১৮১৯২০
২১২২২৩২৪২৫২৬২৭
২৮২৯৩০৩১  
Copyright © Dundeebarta 2024
ডান্ডিবার্তা