টানা চতুর্থবারের মত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা
ডান্ডিবার্তা রিপোর্ট আওয়ামী লীগ টানা চতুর্থবারের মতো এবং পঁচাত্তরের পরবর্তী সময়ে পঞ্চমবারের মতো সরকার গঠন করল। গতকাল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৭ টায় নতুন মন্ত্রিসভা শপথ নেন। কিন্তু পঁচাত্তর পরবর্তীতে আওয়ামী লীগ যে চারটি মন্ত্রিসভা এর আগে গঠন করেছে তার সবগুলোর চেয়ে এবারের মন্ত্রিসভা আকারে ছোট। বিগত মন্ত্রিসভায় ছিল ৪৭ সদস্যের। আওয়ামী লীগ পঞ্চাশ ঊর্ধ্ব মন্ত্রিসভাও গঠন করেছিল। কিন্তু এবারের মন্ত্রিসভা অনেক কম। বাংলাদেশে যতগুলো মন্ত্রণালয় রয়েছে, মন্ত্রিসভার পূর্ণাঙ্গ মন্ত্রীদের সংখ্যা তার চেয়ে কম। সব মিলিয়ে এবার মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন প্রধানমন্ত্রী ছাড়া ৩৬ জন। এই ৩৬ জনের মন্ত্রিসভা বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে ছোট মন্ত্রিসভার মধ্যে একটি। অবশ্যই এ ক্ষেত্রে অনির্বাচিত সরকারের বা সামরিক শাসনের মন্ত্রিসভা বা নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত¡াবধায়ক সরকারের মন্ত্রিসভাকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। বাংলাদেশের যে রাজনৈতিক সংস্কৃতি তাতে মন্ত্রিসভার আকার বড় হয়। কারণ যখন একটি রাজনৈতিক দল বিপুল ভোটে বিজয়ী হয় তখন অনেকেই মন্ত্রিসভায় যোগদানে ইচ্ছুক থাকেন। তাদের মধ্যে একটা প্রতিযোগিতা হয়। এজন্য মন্ত্রিসভায় বেশি সংখ্যক সদস্য। রেখে বিভিন্ন অঞ্চল এবং জেলার মধ্যে সমন্বয় করা হয়। কিন্তু এবারের মন্ত্রিসভা কেন তেমন বড় নয় এই প্রশ্নটি উঠেছে। তবে বিভিন্ন সূত্রগুলো বলছে যে মন্ত্রিসভার এটি পূর্ণাঙ্গ নয়, সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা এবং অন্যরকম পরিস্থিতি এড়ানোর জন্য এবার সবচেয়ে দ্রæততম সময়ের মধ্যে মন্ত্রিসভা গঠন করা হয়েছে। সামনের দিনগুলোতে আস্তে আস্তে এই মন্ত্রিসভার আকৃতি প্রকৃতি বাড়ানো হবে। অতীতেও দেখা গেছে যে সময়ের সাথে সাথে মন্ত্রিসভাকে বড় করা হয়েছে। বিভিন্ন সূত্রগুলো বলছে যে মন্ত্রিসভাটি গঠন করা এবার সাংবিধানিক কারণে অত্যন্ত জরুরি ছিল। বিশেষ করে বিএনপির নির্বাচন বর্জন এবং নির্বাচন পরবর্তী সময়ে আন্তর্জাতিক মহলের অবস্থান কী হবে তা নিয়ে এক ধরনের চ্যালেঞ্জ ছিল। সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্যই দ্রæত মন্ত্রিসভা গঠন করা হয়েছে এবং এই মন্ত্রিসভা গঠনের ক্ষেত্রে পুরনো মন্ত্রিসভায় যারা সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করেছে বা মোটামুটি দায়িত্ব পালন করেছে, তাদেরকেই রাখা হয়েছে। কৌশলগত কারণে কয়েকজনকে বাদ দেওয়া হয়েছে। আর বেশিরভাগ বাদ দেওয়া হচ্ছে অযোগ্যতা এবং ব্যর্থতার কারণে। আর এই সমস্ত মন্ত্রীদেরকে রেখে নতুন কিছু মন্ত্রী যোগ করা হয়েছে। তবে কিছুদিন পর মন্ত্রিসভার পূর্ণাঙ্গ অবয়ব দেখা যাবে। আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রতিবারই মন্ত্রিসভা গঠনের ক্ষেত্রে কিছু কৌশল অবলম্বন করেন। এবার হয়তো তিনি ধাপে ধাপে মন্ত্রিসভার পরিধি বাড়ানোর পরিকল্পনা গ্রহণ করেছেন। তবে একাধিক সূত্র বলছে যে, আজকে মন্ত্রিসভার শপথ গ্রহণের পর স্বল্পতম সময়ের মধ্যে মন্ত্রিসভার পরিধি বাড়ানো হবে এবং আস্তে আস্তে মন্ত্রীদের অন্তভুক্ত করা হবে। যেমন ২০০৯ সালেও আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর প্রথম দফায় যারা মন্ত্রী হয়েছিলেন পরবর্তীতে জাহাঙ্গীর কবির নানক সহ কয়েকজনকে মন্ত্রী করা হয়েছিল। আরও পরে মন্ত্রী করা হয়েছিল ওবায়দুল কাদেরকে। এটি একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। এবারও মন্ত্রিসভার এটি শেষ নয়। সামনের দিনগুলোতে মন্ত্রিসভার আকার বাড়লেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। গতকাল বৃহস্পতিবার বিকালে একে একে রাষ্ট্রপ্রধানের সরকারি বাসভবনে প্রবেশ করেন তারা। সন্ধ্যা ৭টায় নতুন মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীদের শপথবাক্য পাঠ করান রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন। এই শপথের মধ্য দিয়েই টানা চতুর্থ মেয়াদে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব নেন আওয়ামী লীগ। আর আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা পঞ্চম মেয়াদে বাংলাদেশের সরকারপ্রধানের দায়িত্ব নিয়ে গড়েছেন ইতিহাস। নিয়ম অনুযায়ী প্রথমে প্রধানমন্ত্রীকে শপথবাক্য পাঠ করান রাষ্ট্রপতি। পরে পর্যায়ক্রমে মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রীরা শপথ নেন। এরপর তারা নিজ নিজ শপথবাক্যে স্বাক্ষর করেন। পরে প্রধানমন্ত্রী নবনিযুক্ত মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রীদের মধ্যে দফতর বণ্টন করেন। শপথ অনুষ্ঠান পরিচালনা করবেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব মো. মাহবুব হোসেন। গতকাল বৃহস্পতিবার মন্ত্রী হিসেবে যারা শপথ নিলেন, আ ক ম মোজাম্মেল হক, ওবায়দুল কাদের, নূরুল মজিদ হুমায়ূন, আসাদুজ্জামান খান কামাল, ডা. দীপু মনি, মো. তাজুল ইসলাম, মুহাম্মদ ফারুক খান, আবুল হাসান মাহমুদ আলী, আনিসুল হক, হাছান মাহমুদ, মো. আব্দুস শহীদ, সাধন চন্দ্র মজুমদার, র আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী, মো. আব্দুর রহমান, নারায়ণ চন্দ্র চন্দ, আব্দুস সালাম, মহিবুল হাসান চৌধুরী, ফরহাদ হোসেন, মো. ফরিদুল হক খান, মো. জিল্লুল হাকিম, সাবের হোসেন চৌধুরী, জাহাঙ্গীর কবির নানক, নাজমুল হাসান, স্থপতি ইয়াফেস ওসমান ও সামন্ত লাল সেন। মন্ত্রীদের মধ্যে স্থপতি ইয়াফেস ওসমান ও সামন্ত লাল সেন টেকনোক্র্যাট মন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন। আর প্রতিমন্ত্রী হিসেবে যারা শপথ নেন, সিমিন হোমেন রিমি, নসরুল হামিদ, জুনাইদ আহমেদ পলক, মোহাম্মদ আলী আরাফাত, মো. মহিববুর রহমান, খালিদ মাহমুদ চৌধুরী, জাহিদ ফারুক, কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা, রুমানা আলী, শফিকুর রহমান চৌধুরী ও আহসানুল ইসলাম (টিটু)। শপথ নেওয়ার পর পরই তাদের দপ্তর বণ্টনের প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। পূর্ন মন্ত্রী হিসেবে যারা দায়িত্ব পেলেন তারা হলেন, আ ক ম মোজাম্মেল হক- মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়। ওবায়দুল কাদের- সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়। আবুল হাসান মাহমুদ আলী- অর্থ মন্ত্রণালয়। আনিসুল হক- আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়। নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূন- শিল্প মন্ত্রণালয়। আসাদুজ্জামান খান (কামাল)- স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। মো. তাজুল ইসলাম- স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। মুহাম্মদ ফারুক খান- বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন বিষয়ক মন্ত্রণালয়। মোহাম্মদ হাছান মাহমুদ- পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। ডা. দীপু মনি- সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়। সাধন চন্দ্র মজুমদার- খাদ্য মন্ত্রণালয়। আব্দুস সালাম- পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়। মো. ফরিদুল হক খান- ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয়। র আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী- গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়। নারায়ণ চন্দ্র চন্দ- ভূমি মন্ত্রণালয়। জাহাঙ্গীর কবির নানক- বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়। মো. আব্দুর রহমান- মৎস্য ও প্রাণি সম্পদ মন্ত্রণালয়। মো. আব্দুস শহীদ- কৃষি মন্ত্রণালয়। স্থপতি ইয়াফেস ওসমান- বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়। ডা. সামন্ত লাল সেন-স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়। মো. জিল্লুল হাকিম- রেলপথ মন্ত্রণালয়। মো. ফরহাদ হোসেন- জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। নাজমুল হাসান (পাপন)- যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়। সাবের হোসেন চৌধুরী- পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক মন্ত্রণালয়। মহিবুল হাসান চৌধুরী- শিক্ষা মন্ত্রণালয়। প্রতিমন্ত্রী হিসাবে যারা যে মন্ত্রনালয়ের দায়িত্ব পেলেন তারা হলেন, নসরুল হামিদ- বিদ্যুৎ বিভাগ। খালিদ মাহমুদ চৌধুরী- নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়। জুনাইদ আহমেদ পলক- ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়। জাহিদ ফারুক- পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়। সিমিন হোমেন রিমি- মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়। কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা- পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়। মো. মহিববুর রহমান- দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়। মোহাম্মদ আলী আরাফাত- তথ্য ও স¤প্রচার মন্ত্রণালয়। শফিকুর রহমান চৌধুরী- প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়। রুমানা আলী- প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। আহসানুল ইসলাম (টিটু)- বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এর আগে, দ্বাদশ জাতীয় সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের আস্থাভাজন সংসদ সদস্য শেখ হাসিনাকে প্রধানমন্ত্রী পদে নিয়োগের সিদ্ধান্ত দেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন। গত বুধবার সন্ধ্যায় মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। শেখ হাসিনাকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগের পাশাপাশি তার নেতৃত্বে নতুন মন্ত্রিসভা গঠনের সম্মতিও দেন রাষ্ট্রপতি। নতুন মন্ত্রিসভা গঠনের সঙ্গে সঙ্গে বর্তমান মন্ত্রিসভা ভেঙে দেওয়া হয়েছে বলেও গণ্য করার কথা বলা হয়েছে প্রজ্ঞাপনে। এর আগে গত বুধবার সকাল ১০টায় দ্বাদশ জাতীয় সংসদ সদস্য হিসেবে শপথ নেন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনাসহ নবনির্বাচিত ২৯৮ সংসদ সদস্য। তার আগে সংসদ সদস্য হিসেবে প্রথমে শপথ গ্রহণ করেন বর্তমান স্পিকার শিরীন শারমীন চৌধুরী। এরপর স্পিকার হিসেবে তিনি শেখ হাসিনাসহ অন্য সংসদ সদস্যদের শপথ বাক্য পাঠ করান। জাতীয় পার্টি ও স্বতন্ত্র হিসেবে বিজয়ীরাও এদিন শপথ নেন। সংসদ নেতা হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ নিয়ে পঞ্চমবারের মতো সংসদ নেতা হলেন তিনি। একাদশ সংসদে মতিয়া চৌধুরী ছিলেন সংসদ উপনেতা। এবারও এ পদে তাকে বেছে নিয়েছে আওয়ামী লীগ। চিফ হুইপ হয়েছেন গত সংসদে এ পদে দায়িত্ব পালন করা নূর-ই-আলম চৌধুরী। শপথ নেওয়ার মাধ্যমে বাংলাদেশে দ্বাদশ সংসদ গঠিত হয়। বাকি ছিল প্রধানমন্ত্রী নিয়োগের বিষয়টি। রাষ্ট্রপতি নিয়োগ দেওয়ার পর সে কাজটিও সম্পন্ন হয়ে যায়। গত রবিবার দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে বিজয় পেয়ে টানা চতুর্থ মেয়াদে সরকার গঠন করেছে আওয়ামী লীগ। নির্বাচনে ২২৩টি আসনে বিজয়ী হয়েছে নৌকা। জোট শরিকরাও নৌকা প্রতীকে নির্বাচন করে দুটি আসন পেয়েছেন। জাতীয় পার্টি ১১ ও কল্যাণ পার্টি একটি আসন পেয়েছে। প্রথমবারের মতো স্বতন্ত্র প্রার্থীরা ৬২ আসন বাগিয়ে নিয়েছেন, যদিও তাদের মধ্যে বেশির ভাগই আওয়ামী লীগের নেতা।