আজ মঙ্গলবার | ১২ আগস্ট ২০২৫ | ২৮ শ্রাবণ ১৪৩২ | ১৭ সফর ১৪৪৭ | রাত ৩:৪৩

বাংলার প্রতি আমরা কতটা আন্তরিক

ডান্ডিবার্তা | ০৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ | ১০:০৪ পূর্বাহ্ণ

দিনপঞ্জিকার পিঠে চড়ে ফেব্রæয়ারি এসে গেল। বাংলা ভাষাভাষী ও বাংলাদেশিদের জন্য মাসটি অত্যন্ত গুরুত্বের। নিজের ভাষা বাংলায় কথা বলার অধিকারের আন্দোলন তীব্র আকার ধারণ করে বায়ান্নর এই মাসে এবং সেই আন্দোলনে শহীদ হন সালাম, বরকতেরা। ভাষা আন্দোলন পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশকে একটা স্বতন্ত্র রাষ্ট্র হিসেবে পেতে বড় প্রভাবকের কাজ করেছে। ২১ ফেব্রæয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। একটা প্রশ্ন মনে উঁকি দেয়—মাতৃভাষা আমাদের বাংলা, এই ভাষার জন্যই আন্দোলন, শহীদ হওয়ার ঘটনা; অথচ ইংরেজি বর্ষের ফেব্রæয়ারিকে আমরা ভাষার মাস হিসেবে স্মরণ করি কেন? এতে বাঙালির মাতৃভাষার মর্যাদা কতটা রক্ষা পায়? বাংলা মাসের তারিখ কেন বর্জিত হলো? আমার মনে হয়, বিষয়টি নিয়ে ভাবনার সুযোগ আছে। ফেব্রæয়ারি মাস সামনে রেখে একসময় বলা হয়েছিল, সব সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ‘সাইনবোর্ড’ হতে হবে বাংলায় লেখা। অনেকেই ইংরেজি শব্দটা বাংলায় লিখলেন, কিন্তু ইংরেজি শব্দের জায়গায় আভিধানিক অর্থে কোনো বাংলা শব্দ জায়গা পেল না। তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ—বাংলা একাডেমি, শিল্পকলা একাডেমি, শিশু একাডেমি ইত্যাদি। তবে কি ‘একাডেমি’ শব্দটার কোনো বাংলা নেই? বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত বাংলা অভিধানেও নেই? একজন সাধারণ মানুষ বললেন, ‘যাই বলেন, ব্রিটিশরা তাদের অনুগতদের ভালো শিক্ষা দিয়ে গেছে। যা-ই করেন না কেন, সেই শিক্ষা থেকে তাদের আর বের করতে পারবেন না।’ যাহোক, ফেব্রæয়ারি মাস আবেগ আর ভালোবাসায় পরিপূর্ণ। তবে সেই আবেগ আর ভালোবাসার ধরন সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে পাল্টেছে। আগে যেমন গ্রামগঞ্জের নারীরা ভালোবাসা প্রকাশ করত এক টুকরো কাপড়ে রঙিন সুতোয় দুটো কথা লিখে। যে কথা থাকত আকুতিতে ভরা। কিংবা হলুদ খামে আঁকাবাঁকা শব্দে চিঠি লিখে পাঠানো হতো প্রিয় মানুষকে। এখন সেই সব কেবলই স্মৃতি। গ্রামীণ মানুষের সেই আবেগ-অনুভূতির ধরন বেশ বদলেছে এবং সেটা আধুনিকায়নের অজুহাতে। এখন ‘মোবাইল ফোনের’ মতো আধুনিক ‘ডিভাইস’ প্রায় প্রতিটি মানুষের হাতে। ভালোবাসা আর আবেগের কথা প্রকাশের কোনো পূর্ব আয়োজন বা প্রস্তুতি লাগে না। নিমেষেই এখন সব হয় এবং তা প্রযুক্তি বা আধুনিকায়নের বদৌলতে। কষ্ট করে দুটো কথা লেখাকে এখন সবাই মনে করে সময়ের অপচয়। ফলে গ্রামীণ সেই নির্মল অনুভূতি বিলুপ্তপ্রায়। আবেগ,-অনুভূতির ব্যাপারটা ব্যক্তির ভেতর থেকে হারিয়ে যাচ্ছে। এতে আবেগী কিংবা অনুভূতিপ্রবণ মানুষকে অন্যরা রীতিমতো পাগল বলে ভেবে বসছে! শৈশবে ভাষার মাসের অর্থ ছিল ব্যাপক আয়োজনের ও প্রস্তুতির। হাজার কথা লেখা ও বলার মাস কেবল নয়, বাঙালির অধিকার অনুভবের মাস। যে যেভাবে পেরেছে ফেব্রæয়ারিকে ধারণ করেছে, প্রকাশ করেছে। তখন পাড়ায় পাড়ায়, মহল্লার অলিতে-গলিতে শহীদ মিনার চোখে পড়ত। এসবের অধিকাংশ ছিল কচি কিংবা অদক্ষ হাতের তৈরি। তবে এসব সৃষ্টিকর্মের পেছনে থাকতেন বড়জনেরা। তাঁরাই ছোটদের উৎসাহিত করতেন। ছোটরা কাগজে বাংলা বর্ণ লিখে সুতোয় বেঁধে তা ঝুলিয়ে রাখত শহীদ মিনারে। শৈশবে একুশে ফেব্রæয়ারি নিয়ে কত উপলক্ষ আর আয়োজনের পূর্ব প্রস্তুতি চিন্তা-চেতনায় ঘুরপাক খেত যে, তা ভাবলে আজও শিহরিত হয়ে উঠি। পাড়া-মহল্লার সমবয়সীরা জানুয়ারি মাস এলেই আলাপচারিতায় বসে যেতাম—কী করা যায় আসছে ফেব্রæয়ারিতে। অমর একুশের সংকলন বের করা, পাড়ায় একটা শহীদ মিনার তৈরি করা ও একুশে ফেব্রæয়ারিতে প্রভাতফেরি ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করা নিয়ে চলত জল্পনা-কল্পনা। আর সেই অনুসারে প্রস্তুতি। যখন ম্যাগাজিন বের করা সম্ভব হতো না, তখন দেয়াল পত্রিকার প্রস্তুতি চলত। কখনোবা বাংলায় চিঠি লেখা প্রতিযোগিতার আয়োজন করে নিজেরা নিজেদের পুরস্কৃত করতাম! খরচ যেটুকু হতো, সেটা তোলা হতো সংকলন বিক্রি করে। ছোট্ট হাতের সৃষ্টি বড়রা কিনে নিতেন। বাংলা ভাষার প্রতি সবার যেন একটা দায়বদ্ধতা ছিল। এমনও মনে পড়ে, কারও বাসা থেকে একটা গামছা এনে দুপাশে ধরে কয়েকজন রাস্তায় দাঁড়িয়ে অর্থ সংগ্রহ করেছি, অমর একুশের সংকলন বের করার স্বপ্ন নিয়ে। খালি পায়ে প্রভাতফেরিতে যাওয়ার অনুভূতি ছিল অন্যরকম এক অবর্ণনীয় চেতনার। মায়ের হাত ধরে, কখনো বড়দের লাইনে দাঁড়িয়ে শহীদ মিনারে ফুল দিতে পারার মধ্যে ছিল বড় অর্জন, বড় গৌরব। প্রভাতফেরির গানটা মুখস্থ করা এবং সুন্দরভাবে গাইতে পারাটা কম সুখের ছিল না। একজন বাঙালি হিসেবে নিজের অস্তিত্ব অনুসন্ধানের এ এক বিশাল অনুভূতি। ফেব্রæয়ারি মাস মানেই বাংলা ও বাঙালির মাস। ভাষাই আমাদের একটা স্বতন্ত্র রাষ্ট্র বাংলাদেশ দিয়েছে। আজ যাদের শৈশব, তাদের কাছে ফেব্রæয়ারি ভাষার মাস হিসেবে ঠিকই আছে, তবে উদ্‌যাপনের সেই আবেগ, উচ্ছ¡াস নেই। নেই প্রস্তুতি। সীমিত আনুষ্ঠানিকতার মধ্য দিয়েই তারা ফেব্রæয়ারি মাস উদ্‌যাপন করে। তাদের অনেকেই জানে না বাংলা ভাষা কী এনে দিয়েছে আমাদের জীবনে। তাদের এই না জানার পেছনে রয়েছে বড়দের ব্যর্থতা, এটা না বলে উপায় নেই। বাংলাদেশের বয়স পঞ্চাশোর্ধ্ব। এখনো বাংলা ভাষার প্রতি সবার সমানভাবে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা জাগেনি, কথাটা জোর দিয়ে বললে কতটা ভুল বলা হবে তা বলা মুশকিল। তবে বাংলা ভাষার যে চর্চা, ব্যবহার ও প্রচলন, তা আশাপ্রদ ও সন্তোষজনক নয়। সরকারিভাবে অফিস, আদালত—সর্বত্র দাপ্তরিক কাজে বাংলা ভাষার ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হলেও অনেক জায়গায় এর ব্যতিক্রম পরিলক্ষিত হয়। অনেক জাতীয় পর্যায়ের বেসরকারি উন্নয়ন প্রতিষ্ঠান রয়েছে অথবা অনেক ব্যাংক আছে, যেখানে গেলে মনে হয় যে বিদেশি কোনো প্রতিষ্ঠানের শাখা অফিস মাত্র। সেখানকার সেবাদানকারীরা আচার-আচরণ, পোশাক বা গেটআপে কেবল নয়, ভাষার ব্যবহারে এরা পুরোই ভিনদেশি, ভিন জাতি। এখানে যাঁরা চাকরি করতে আসেন, তাঁরা একসময় বাঙালিয়ানার হলেও পরে ইংরেজ হয়ে পড়ে পরিবেশগত কারণে। ফলে বাংলা ভাষা, বাংলা সংস্কৃতি বিস্মৃত হয়। এরা না হয় বাঙালি, না ইংরেজ। উপরন্তু, এদের কাছে পয়লা বৈশাখে পান্তা-ইলিশ খাওয়া এমনকি বাংলা ভাষাও শৌখিনতায় পরিণত হয়। দেশীয় এসব প্রতিষ্ঠানে বাংলা ভাষার ব্যবহার না হওয়াটা ব্যর্থতার পর্যায়ে পড়ে কি না, ভেবে দেখা দরকার। কেবল বিদেশিদের জন্য ইংরেজি ভাষা ব্যবহার দরকার।




Your email address will not be published.

Comments are closed.


আজকের পত্রিকা
আজকের পত্রিকা
ফেসবুকে আমরা
পুরনো সংখ্যা
সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি রবি
 
১০
১১১২১৩১৪১৫১৬১৭
১৮১৯২০২১২২২৩২৪
২৫২৬২৭২৮২৯৩০৩১
Copyright © Dundeebarta 2024
ডান্ডিবার্তা