হাসপাতালে স্বজন হারানোর বেদনায় বইছে অশ্রæ ঝড়না
ডান্ডিবার্তা রিপোর্ট রাজধানীর বেইলি রোডে একটি বহুতল ভবনে অগ্নিকাÐে এখন পর্যন্ত ৭৫ জনকে উদ্ধার করা হয়েছে। এর মধ্যে মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছে ৪৬ জনের এবং গুরুতর আহত হয়ে সঙ্কটাপন্ন অবস্থায় আছেন ১২ জন। এদের কেউ দুর্ঘটনাকবলিত ভবনটির রেস্তোরাঁয় খেতে গিয়েছিলেন পরিবারসহ, কেউ গিয়েছিলেন বন্ধুদের সঙ্গে ডিনার করতে আবার কেউ গিয়েছিলেন ভবনটিতে কাজ করে সংসার চালাতে। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস আজ তাদের অধিকাংশ মৃত। এ ঘটনায় নিহতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। ফায়ার সার্ভিসের তথ্য অনুসারে গত বৃহস্পতিবার রাত পৌনে ১০টার দিকে বেইলি রোডের ওই ভবনটিতে আগুন লাগে। আগুন নেভানোর পর হতাহত ব্যক্তিদের উদ্ধার করে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল এবং শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে আনা হয়। এই ঘটনায় মৃতদের পরিচয় শনাক্তের পর স্বজনদের কাছে মরদেহ হস্তান্তর করা হয়েছে। কয়েকজনের দাফনও সম্পন্ন হয়েছে এরইমধ্যে। ৪৬টি মরদেহের মধ্যে পরিচয় শনাক্তের পর ৪১টি মরদেহ স্বাজনদের কাছে হস্তান্তর করেছে কর্তৃপক্ষ। সরেজমিনে দেখা যায়, স্বজনদের হারিয়ে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল এবং শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে অসংখ্য মানুষ আহাজারি করেছিলেন। তাদের মধ্যে ফজর আলী (৪৬) তার ছেলে মো. শিপন (২০)-কে হারিয়ে বার্ন ইউনিটের জরুরি বিভাগে আর্তনাদ করছিলেন। জরুরি বিভাগের ফ্লোরে বসে কান্না করতে করতে বলেন, ৩৫ দিন আগে আমি আমার মাকে হারিয়েছি, আজকে আমার ছোট ছেলেকে। আমার ছেলে ওখানে গেছে গ্যাসের কাজ করতে। আহা রে আমার চোখের মণি, আমার কলিজা চোখের সামনে মরে গেলো। আমি এখন কারে নিয়ে বাঁচবো। অভাবের সংসারে ছোট ছেলেটা সংসার চালাতে আমাকে সাহায্য করতো। এখন সেও চলে গেলো। স্বজন হারানো আরেকজন নজরুল ইসলাম। ছেলেকে হারিয়ে একবার দৌড়ে যাচ্ছেন ঢাকা মেডিক্যাল হাসপাতালের মর্গে, একবার যাচ্ছেন শেখ হাসিনা বার্ন ইনস্টিটিউটে। কিন্তু এখন পর্যন্ত ছেলেকে শনাক্ত করতে পারেননি। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের জরুরি বিভাগের সামনে আহাজারি করে নজরুল ইসলাম বলেন, ‘আমার ছেলে ব্র্যাক ইউনিভার্সিটিতে কম্পিউটার সায়েন্সে পড়ালেখা করে। গতকাল রাতে তারা চার বন্ধু মিলে বেইলি রোডের কাচ্চি ভাইতে খেতে যায়। সেই সময় অগ্নিকাÐের ঘটনা ঘটে। সেখান থেকে তিন বন্ধু বের হতে পারলেও নাজমুল আটকা পড়ে। তার বন্ধু জুনায়েদ ফোন দিয়ে আমাদের জানায়, নাজমুলকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এরপর আমরা ঘটনাস্থলে যাই কিন্তু সেখানে আমার ছেলেকে খুঁজে পাইনি। তারপর ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মর্গেও তাকে খুঁজেছি কিন্তু পাইনি। কয়েকটা পোড়া লাশ মর্গে পড়ে আছে। চিনতে পারছি না কোনটা আমার ছেলে।’ এদিকে দুর্ঘটনা থেকে বেঁচে আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করেছেন বেশ কয়েকজন আহত ব্যক্তি। তাদের মধ্যে একজন স্বাস্থ্য অধিদফতরের ডিপিএম এইচ এম কামরুজ্জামান। আগুন লাগা ভবনটির ৯ তলায় তিনি রাতে খেতে গিয়েছিলেন। তিনি বলেন, এমন অবস্থায় ছিলাম যে বেঁচে ফিরে আসবো বলে মনে হয়নি। আল্লাহর কাছে শুকরিয়া। আমি ছিলাম ৯ তলায়। যখন আগুন লাগার খবর শুনলাম তখন সবাই ছোটাছুটি করছিল। মুহুর্তের মধ্যে উপরে ধোঁয়া চলে এসেছি। সবাই দম বন্ধ হয়ে মারা যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। তার খানিকটা পর আমি হাত দিয়ে কাচ ভেঙে ফেলেছি ঠিকমতো সবাই নিঃশ্বাস নেওয়ার জন্য। এতে আমার হাত অনেকটা কেটে যায়। পরে ফায়ার সার্ভিসের মই দিয়ে এক এক করে বেশ কয়েকজনকে বের করেছি। তারপর আমি নিজেও বের হয়ে এসেছি। বের হওয়ার পর আমার অবস্থা খুব খারাপ ছিল। হঠাৎ মনে হলো উপরে এখনও অসংখ্য মানুষ আছে। আমি সাথে সাথে ফায়ার সার্ভিসের সদস্যদের তা জানিয়েছি। আমার সামনে অনেকে ধোঁয়ায় জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে। আমি কিচ্ছু করতে পারিনি। দুর্ঘটনায় হতাহতের ঘটনায় শেখ হাসিনা বার্ন ইনস্টিটিউটের সামনে স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. সামন্ত লাল সেন দুঃখ প্রকাশ করে সাংবাদিকদের বলেন, “গত বৃহস্পতিবার রাতে বেইলি রোডে একটা অত্যন্ত মর্মান্তিক দুর্ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় আমাদের বার্ন ইউনিটে ১০টি মৃতদেহ এবং ঢাকা মেডিক্যালে আসে ৩৫টি। আজকে সকালে ঢাকা মেডিক্যালে আইসিউতে আরও একজনের মৃত্যু হয়েছে। সব মিলিয়ে আমাদের জানা মতে, ৪৬ জন মারা গেছেন। মন্ত্রী আরও বলেন, যারা মারা গেছেন তারাও কার্বন মনোক্সাইড পয়জনিংয়ের শিকার হয়েছে। অর্থাৎ, একটা বদ্ধ ঘরে যখন বের হতে পারে না, তখন ধোঁয়াটা শ্বাসনালীতে চলে যায়। প্রত্যেকেরই তা হয়েছে। যাদের বেশি হয়েছে তারা মারা গেছেন। তবে যারা আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি, তারা কেউ শঙ্কামুক্ত নয়। আহতদের সব দায়িত্ব প্রধানমন্ত্রী নিয়েছেন। সরকারের পক্ষ থেকে সব ধরনের চিকিৎসার ব্যয় বহন করা হবে।