প্রশাসনকে হকারদের চ্যালেঞ্জ
ডান্ডিবার্তা রিপোর্ট নারায়ণগঞ্জের সাধারণ হকারদের ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছে একটি চাঁদাবাজ চক্র। হকার নেতা সেজে চাঁদাবাজি করাই তাদের প্রধান ও একমাত্র কাজ। এদিকে, এইসব হকার নেতাদের বিরুদ্ধে আছে হত্যা, চাঁদাবাজি, পুলিশের উপর হামলা ও অস্ত্র লুটের চেষ্টার মামলা। তাদের মধ্যে অনেকে আবার মেয়রের উপর হামলার চার্জশিটভুক্ত আসামি। সম্প্রতি প্রকাশ্য সমাবেশ করে একাধিক হকার নেতা জনপ্রতিনিধি ও প্রশাসনকে চ্যালেঞ্জ করে বলেছেন, অস্ত্র জমা দিয়েছি টেনিং জমা দেইনি। তাদের এই বক্তব্য নারায়ণগঞ্জ শহরের জন্য অশনি সংকেত বলে মনে করছেন নগরবাসী। অনতিবিলম্বে এইসব উস্কানীদাতাদের আইনের আওতায় আনার দাবি জনিয়েছেন নগরবাসী। হকারদের জন্য নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন হকার্স মার্কেট করে দিলেও অনেকেই সেই দোকান বিক্রি করে দিয়ে ফুটপাত কিংবা রাস্তা দখল করে হকারি করছে। ফুটপাত সাধারণ মানুষের চলাচলের জন্য করা হলেও নগরীর বঙ্গবন্ধু সড়ক, শায়েস্তা খাঁ সড়ক, সিরাজউদ্দৌলা সড়ক, শহীদ সোহরাওয়ার্দী সড়ক, মীর জুমলাসহ সবকয়টি সড়কে ছিল হকারদের দৌরাত্ম্য। এইসব হকার নেতারা মাসে মাসে লাখ লাখ টাকা চাঁদা আদায় করছে। গত বছর রমজানে শুধু বঙ্গবন্ধু সড়ক থেকেই ৩ কোটি টাকা চাঁদা উঠেছিল বলে তখন একাধিক জাতীয় গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়। গত ৩ ফেব্রুয়ারি নারায়ণগঞ্জ প্রেস ক্লাবে এক গোলটেবিল বৈঠকে নারায়ণগঞ্জ সিটি মেয়র, দুই সংসদ সদস্য, জেলার ডিসি ও এসপি শহরকে ‘হকার ও যানজটমুক্ত’করতে ঐক্যমতে পৌঁছান। এরপরই নগরীর বঙ্গবন্ধু সড়ক, শায়েস্তা খাঁ সড়ক, সিরাজউদ্দৌলা সড়ক, শহীদ সোহ্রাওয়ার্দী সড়ক, মীর জুমলাসহ সবকয়টি সড়ক থেকে হকার ও অবৈধ স্ট্যান্ড উচ্ছেদ করা হয়। এতে নগরবাসীর মধ্যে স্বস্তি এলেও নারায়ণগঞ্জ শহরের ফুটপাতে ফের বসতে দেওয়ার দাবিতে আন্দোলনে নেমেছে হকাররা। বামপন্থি রাজনৈতিক দল সিপিবির নেতৃত্বে হকাররা সভা সমাবেশ ও স্মারকলিপি দেয়ার কর্মসূচি পালন করছে তারা। হকারদের নেতৃত্বে আছে কথিত হকার নেতা রহিম মুন্সী, আসাদুল ইসলাম, সোহেল, পলাশ। নিজেকে হকার নেতা বলে দাবি করলেও নারায়ণগঞ্জ শহরে চাঁদাবাজ হিসেবে পরিচিত আসাদুল ইসলাম আসাদ। আসাদ নারায়ণগঞ্জ জেলা হকার সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক। নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের মেয়রের উপর হামলা, প্রকাশ্যে তরুণ হকারকে ছুরিকাঘাতে হত্যা, পুলিশের উপর হামলা, সড়কে অগ্নিসংযোগের অভিযোগে তিনটি মামলার আসামি সে। দু’টি মামলার তদন্ত শেষে অভিযোগপত্রেও আসামির তালিকায় রয়েছে আসাদের নাম। তবুও শহরের ফুটপাত দখল করে ব্যবসা করা হকারদের কাছ থেকে প্রকাশ্যে নিয়মিত চাঁদা তোলে সে। হকার্স লীগের সভাপতি রহিম মুন্সীর বিরুদ্ধে রয়েছে দুইটি মামলা। সে মেয়রের উপর হামলা ও পুলিশের উপর হামলা, সড়কে অগ্নিসংযোগের অভিযোগে করা মামলার আসামি। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, আসাদুল ইসলাম, রহিম মুন্সী ও পলাশ ২০১৮ সালে ১৬ জানুয়ারি হকার ইস্যুকে কেন্দ্র করে সিটি মেয়র ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভীর উপর হামলার ঘটনার চার্জশিটভুক্ত আসামি। ওই ঘটনায় সিটি করপোরেশনের আইন কর্মকর্তা আব্দুস সাত্তার বাদী হয়ে সিটি মেয়রের পক্ষে হত্যাচেষ্টার অভিযোগে একটি মামলা করেন। ওই মামলার তদন্ত শেষে ২০২২ সালের ২৩ নভেম্বর আদালতে মামলাটির অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। অভিযোগপত্রের ১২ আসামির মধ্যে মহানগর হকার্সলীগের সভাপতি রহিম মুন্সি, আসাদ, পলাশের নাম রয়েছে। এরপর ২০২১ সালের ৯ মার্চ ফুটপাতে বসার দাবিতে বিক্ষোভ করে হকাররা। ওই সময় হকারদের নেতৃত্ব দেয় রহিম মুন্সী ও আসাদ। ওইদিন বিকেলে সড়কে আগুন দিয়ে যানবাহনে ভাঙচুর চালায় হকাররা। বাধা দিলে পুলিশের সাথে তাদের সংঘর্ষ বাধে। ওই ঘটনায় পুলিশের উপর হামলা, অস্ত্র লুটের চেষ্টা, যানবাহন ভাঙচুর ও সড়কে আগুন দিয়ে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির অভিযোগে গ্রেপ্তার হয় আসাদ। পরদিন পুলিশের এক মামলায় আসাদসহ ২৫০ জনকে আসামি করা হয়। এই মামলা রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদও করা হয় আসাদকে। একই বছরের ১৪ অক্টোবর ফুটপাতে দোকান বসানোকে কেন্দ্র করে তর্কের জেরে খুন হন ১৮ বছর বয়সী তরুণ জোবায়ের হোসেন। ওই তরুণও ফুটপাতে হকারি করতো। তাকে পিটিয়ে ও ছুরিকাঘাতে খুন করা হয়। ওই হত্যা মামলারও আসামি আসাদ। মামলাটির অভিযোগপত্রেও রয়েছে তার নাম। হত্যা মামলাটিতে জেলেও যায় আসাদ। জামিনে বেরিয়ে এসে নিহত জুবায়েরের পরিবারকে মামলা তুলে নিতে হুমকি দেওয়ার অভিযোগ ওঠে তার বিরুদ্ধে। নিহত জুবায়েরের মা মুক্তা বেগম এই ঘটনায় থানায় আরও একটি অভিযোগ দায়ের করেন। শহরের জেলা সরকারী গণ গ্রন্থাগারের বিপরীতে শায়েস্তা খান রোড থেকে চাঁদা তোলে সোহেল। ২০২১ সালের ১৩ মার্চ ফুটপাতে চাঁদাবাজি করার সময় চাঁদাবাজির টাকাসহ সোহেলের সহযোগী মো. আব্দুল্লাহ ওরফে বিজয় চন্দ্র দাস নামের এক চাঁদাবাজকে হাতে-নাতে গ্রেফতার করে র্যাব। সেইসময় র্যাব-১১ এর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. জসিম উদ্দীন চৌধুরী, পিপিএম জানান, পলাতক আসামি সোহেলের নেতৃত্বে চাঁদাবাজ চক্র দীর্ঘদিন ধরে সরকারী গণ গ্রন্থাগারের বিপরীতে শায়েস্তা খান রোডের ফুটপাতের অস্থায়ী দোকানগুলো হতে দোকানপ্রতি ৪০ থেকে ১০০ টাকা চাঁদা আদায় করে। সোহেলের পিতা ফুটপাতের আরেক চাঁদাবাজ মহসীন ব্যাপারী মেয়র আইভীর উপর হামলার ঘটনার আরেক চার্জশিটভুক্ত আসামি। এদিকে সাধারণ হকাররা নাম না প্রকাশ করার শর্তে বলছেন, তারা পরিবার নিয়ে খেয়ে পড়ার জন্য হকারি করছেন। তাদের কোন রাজনৈতিক অভিলাষ নেই। ফুটপাতে হকারি করলেও তারা বিভিন্নজনকে চাঁদা দিয়েই ব্যবসা করতে হচ্ছে। মুখ খুলতে পারছেন না বলে তারা কতিপয় হকার নেতার চাঁদাবাজির কাছে জিম্মি হয়ে পড়ছেন। নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের মেয়র ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী এক সভায় বলেন, ‘শহরের ২০ লাখ মানুষের অধিকার খর্ব করে হকার নামধারী চিহ্নিত চাঁদাবাজরা শহরে আন্দোলন করছে। তাহলে কী আমরা নগরবাসী কতিপয় চাঁদাবাজ ও ফুটপাতে প্রকাশ্যে হত্যাকারীদের কাছে জিম্মি হয়ে গেলাম?’