টিসিবি পন্য নিয়ে নয়-ছয় তিন কাউন্সিলরকে কারণ দর্শানো নোটিশ
ডান্ডিবার্তা রিপোর্ট নারায়ণগঞ্জে টিসিবি পন্য বিতরণে অনিয়ম ও দুই কাউন্সিলরের মধ্যে বিরোধে সর্বত্র সমালোচনা ও আলোচনা চলছে। এরই মধ্যে “নাসিক ১৮নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর মুন্না ও ডিলার পলাশ মিলে টিসিবি’র পণ্যে নয়-ছয়” এবং “বন্দরে নারী কাউন্সিলরকে পুরুষ কাউন্সিলরের চড়-থাপ্পর” মারার ঘটনায় নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসকের নিকট অভিযোগের বিষয়ে অবহিত করণের নিমিত্তে তদন্তপূর্বক ব্যবস্থাগ্রহণ সাপেক্ষে কারণ দর্শানো নোটিশ এর সুপারিশ প্রদান করেছেন ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি)’র ঢাকা আঞ্চলিক কার্যালয়ের যুগ্ম পরিচালক অফিস প্রধান মো. হুমায়ুন কবির। গত ১০ মার্চ টিসিবি ঢাকা আঞ্চলিক কার্যালয়ের যুগ্ম পরিচালক অফিস প্রধান মো. হুমায়ুন কবির এর স্বাক্ষরিত পেইডে ‘দৈনিক যুগের চিন্তা পত্রিকায় প্রকাশিত খবরের বিষয়ে সুপারিশ প্রদান প্রসঙ্গে বলা হয় নাসিক ১৮ নং ওয়ার্ডে টিসিবি কার্ডধারীরা নিয়মিত টিসিবি’র পণ্য পান না মর্মে উক্ত পত্রিকা হতে জানা যায়। সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ডের কাউন্সিলর কামরুল হাসান মুন্না নিজেই টিসিবি’র পণ্য নিয়ন্ত্রণ করেন এবং উক্ত ওয়ার্ডে অন্য কোন ডিলার টিসিবি’র পণ্য বরাদ্দ পেলে সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ডের ডিলার আহসান হাবিব পলাশ তাদের জিম্মি করে মালামাল নিয়ে যায় মর্মে উক্ত পত্রিকা উল্লেখ করেন। এছাড়া, নাসিক ২৬নং ওয়ার্ডে সংরক্ষিত নারী কাউন্সিলর সানিয়া আক্তার টিসিবি’র পণ্য গুণতে চাওয়ায় উক্ত ওয়ার্ডের পুরুষ কাউন্সিলর মোঃ সামসুজ্জোহার হাতে লাঞ্চিত হয় মর্মে উক্ত পত্রিকা হতে জানা যায়। বিষয়টি টিসিবি তথা সরকারের জন্য বিব্রতকর। যেহেতু নারায়ণগঞ্জ সিটির ডিলারদের পণ্য বিক্রির মনিটরিং জেলা প্রশাসনের ট্যাগ কমিটির মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা হয় তাই এক্ষেত্রে নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসক মহোদয় এর সুপারিশ প্রয়োজন ও কারণ দর্শানো (নোটিশ)। এমতাবস্থায়, উপরোক্ত অভিযোগের বিষয়ে অবহিত করণের নিমিত্ত তদন্তপূর্বক ব্যবস্থাগ্রহণ সাপেক্ষে সুপারিশ প্রদান করার জন্য জেলা প্রশাসক মহোদয়, নারায়ণগঞ্জ কে বিশেষভাবে অনুরোধ করা হলো। উল্লেখ্য, গত ৬ মার্চ দৈনিক যুগের চিন্তার পত্রিকায় “নাসিক ১৮নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর মুন্না ও ডিলার পলাশ মিলে টিসিবি’র পণ্যে নয়-ছয়” শিরোনামে একটি সংবাদ প্রকাশ করা হয়। সেখানে লিখা ছিলো, সকাল থেকে বিকেল ও বিকেল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত লাইনে দাঁড়িয়েও টিসিবি পণ্য নিতে ব্যর্থ হচ্ছেন অগণিত মানুষ। নারায়ণগঞ্জ জেলা ও উপজেলার বিভিন্ন ওয়ার্ডে চলছে টিসিবির পণ্য বিক্রির কার্যক্রম। কিন্তু এই টিসিবি পণ্য লুট ও কারচুপি হবার কারণে গত বছর থেকে স্মার্ট ডিজিটাল পরিবার পরিচিতি কার্ড করেছে সরকার। এই কার্ডের মাধ্যমে প্রতি সপ্তাহে পণ্য নিতে পারবে নি¤œ আয়ের মানুষ। কিন্তু কার্ড থাকলেও পণ্য পাচ্ছেন না অনেকে। এমনই অভিযোগ পাওয়া গেছে নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোারেশনের ১৮নং ওয়ার্ডে। এ বিষয়ে ঐ ওয়ার্ডের বাসিন্দা লিপি আক্তার নামে একজন বলেন, ঘন্টার পর ঘন্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকি। কোন সময় ট্রাক আসবে জানিও না। একটা সময় ট্রাক আসলে পণ্য দেওয়া শুরু করে। অনেক সময় মাল পাই, অনেক সময় পাই না। খালি হাতে ফেরত যেতে হয়। কাউন্সিলর কামরুল হাসান মুন্না নিজে দাঁড়িয়ে থেকে তার লোকদের আগে দেয়। এছাড়াও দেখা যায়, কার্ড আছে লোক নেই। সেই কার্ডের মালামাল মুন্না তার লোকদের দিয়ে পাঠিয়ে দেয়। ভয়ে কিছু বলতেও পারি না। এবিষয়ে নাম প্রকাশ্যে অনিচ্ছুক একজন বলেন, এই ১৮নং ওয়ার্ডে টিসিবি পণ্য নিয়ে চরম ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে ওয়ার্ডের নি¤œ আয়ের মানুষের। ঘন্টার পর ঘন্টা লাইনে দাঁড়িয়েও টিসিবি’র পণ্য পাচ্ছে না অনেকেই। নাসিক ১৮ নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর কামরুল হাসান মুন্না নিজেই নিয়ন্ত্রন করেন টিসিবি পণ্য। বাপ্পী সড়কে তার নিজ কার্যালয়ের সামনে দেওয়া হয় টিসিবির পণ্য। এই ওয়ার্ডের টিসিবি পণ্যের ডিলার হচ্ছে আহসান হাবিব পলাশ। সে কামরুল হাসান মুন্নার লোক। এখানে অন্য কোন ডিলার টিসিবি পণ্য বরাদ্দ পেলে তাকে জিম্মি করে তার থেকে মালামাল নিয়ে যায় আহসান হাবিব পলাশ ও কামরুল হাসান মুন্নার লোকজন। জানা যায়, ডিলার পলাশ অর্ধেক মালামাল বিতরণ করেন ও বাকিটি অন্য জায়গায় বিক্রি করে দেয়। এ বিষয়ে নাম প্রকাশ্যে অনিচ্চুক একজন বলেন, বাহির থেকে পন্য কেনার যাদের সামর্থ্য আছে তারাও এখান থেকে টিসিটি পণ্য নিয়ে যায়। মুন্না তার লোকদের দিয়ে তাদের পণ্য বাড়ি বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়। এছাড়াও কার্যালয়ে বসে মুন্নার চাচাত ভাই রিয়েন তাদের লোকদের কার্ড স্ক্যানিং করে পণ্য রেখে দেয়। এছাড়াও নাসিক ২৬নং ওয়ার্ডের আসা টিসিবির পণ্য গুনে নিতে চাওয়ায় সংরক্ষিত নারী কাউন্সিলর সানিয়া আক্তারকে মারধর ও লাঞ্ছিত করার অভিযোগ উঠেছে ওই ওয়ার্ডের পুরুষ কাউন্সিলর মো. সামসুজ্জোহার বিরুদ্ধে। এই ঘটনায় সানিয়া বন্দর থানায় একটি লিখিত অভিযোগও করেছেন। গত ৫ মার্চ সন্ধ্যা সোয়া ছয়টার দিকে এই ঘটনা ঘটে। এ বিষয়ে বন্দর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) গোলাম মোস্তফা বলেন, নারী কাউন্সিলরের একটি লিখিত অভিযোগ পেয়েছি। তদন্তের জন্য পুলিশ পাঠানো হয়েছে। অভিযোগে কাউন্সিলর সামসুজ্জোহা (৫০) ছাড়াও মো. জাহাঙ্গীর (৩৭), মো. রিপন ওরফে অটো রিপন (৪০) নামে দুইজনকেও অভিযুক্ত করা হয়েছে। কাউন্সিলর সামসুজ্জোহা গত বছরের ৯ জানুয়ারি ২ হাজার পরিবারের জন্য আসা টিসিবির পণ্য বিতরণ না করে বিক্রি করে দেন। এই কারণে বুধবার বিকেলে ২৬ নম্বর ওয়ার্ডে ১৯শ’ পরিবারের জন্য আসা টিসিবির পণ্য বিতরণের আগে গুনে দেখতে চান সানিয়া। এতে বাধা দেন সামসুজ্জোহা। পরে তাকে অকথ্য ভাষায় গালি দিয়ে চর-থাপ্পর মারেন বলে লিখিত অভিযোগে সানিয়া আক্তার উল্লেখ করেছেন। এই সময় কাউন্সিলর সানিয়া আক্তারের ব্যক্তিগত সচিব মো. নাঈমকেও মারধর করা হয় বলে জানান তিনি। মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে সানিয়া আক্তারের স্বামী ২৬ নম্বর ওয়ার্ড স্বেচ্ছাসেবক লীগের সহ-সভাপতি আনিসুর রহমান বলেন, তার স্ত্রী সানিয়া আক্তার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। মারধরের ঘটনার পর তিনি শারীরিকভাবে খুবই বিপর্যস্ত। জানতে চাইলে কাউন্সিলর মো. সামসুজ্জোহা পাল্টা অভিযোগ করে বলেন, ‘কাউন্সিলর সানিয়া আক্তারকে বিকেল চারটায় কল করেছি কিন্তু তিনি এসেছেন সন্ধ্যা ছয়টায়। ততক্ষণে অনেক মানুষকে টিসিবির পণ্য বিতরণ করা হয়ে গেছে। তখন টিসিবির পণ্য গুনতে চাইলে তাকে বলি, বিতরণ থামিয়ে গুনতে গেলে লোকজন অযথা হয়রানি হবে। পরে প্যাকেট গুনলেই তো হবে। কিন্তু সে না শুনে আমার সাথে উচ্চবাচ্য করতে থাকে। এ নিয়ে আমাদের মধ্যে তর্ক হয়। তখন কাউন্সিলর সানিয়ার সচিব আমার দিকে তেড়ে আসে। তাকে চর মারতে গিয়ে কাউন্সিলরের গায়ে গিয়ে পড়ে। হঠাৎ করেই ব্যাপারটা ঘটে গেছে। এ বিষয়ে নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মাহমুদুল হক বলেন, এই ঘটনা গুলো দেখে আমরা কমিশনার, কাউন্সিলর ও টিসিবির ডিলারদের নিয়ে একটা মিটিং করেছি। সেখানে টিসিবির পণ্য বিতরণ, পণ্য উত্তোলন ও স্মার্ট কার্ড তৈরী এগুলো নিয়ে আমরা কিছু ইন্ডিসন নিয়েছি। এ ক্ষেত্রে আমরা চেষ্টা করছি প্রতিটা ওয়ার্ডে যাতে নির্দিষ্ট ডিলারের একটা দোকান থাকে। এই দোকান থেকে যদি এই পণ্য গুলো বিতরণ করা হয় তাহলে আর এই সমস্যাগুলো হবে না। এগুলো নিয়ে কাউন্সিলর বা ডিলারদের মধ্যে এক ধরনের সমস্যা দেখা দিচ্ছে, কিন্তু সব জায়গায় নাই, দুই একটি জায়গায় এমন সমস্যা দেখা দিচ্ছে। ঈদের পরপরই (নির্দিষ্ট দোকান) এটা আমরা করতে পারবো। স্মার্ট কার্ড করার জন্য সিটি কর্পোরেশন থেকে আমাদের যে তথ্য দেওয়ার কথা সেটা আমরা সব কাউন্সিলরদের কাছ থেকে পাইনি। স্মার্ট কার্ড হয়ে গেলে প্রতিটা ওয়ার্ডে ডিলারদের নির্দিষ্ট দোকান থাকতে হবে। যেহেতু সিটি করপোরেশনের ডিলার কম, তাই আমরা এমন ডিলার দেবো যাতে তাদের প্রত্যেকের দোকান থাকে এমন ব্যবস্থা নিচ্ছি। আর পুরুষ কাউন্সিলরের যে ঘটনাটা সেটা আমরা তদন্ত করবো। আর ১৮নং ওয়ার্ডের বিষয়টি ও তদন্ত করে দেখবো।