আন্দোলন এড়িয়ে থাকা নেতাদের তালিকা করছে বিএনপি
ডান্ডিবার্তা রিপোর্ট সরকারবিরোধী আন্দোলনে বিএনপির হাজার হাজার নেতাকর্মী গ্রেপ্তার হলেও রাজপথ থেকে কারা আটক হয়েছেন তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন খোদ দলটির মাঠপর্যায়ের নেতাকর্মীরা। তারা বলছেন, আজকে যদি রাজপথে থেকে নেতারা গ্রেপ্তার হতেন তাহলে তারা দলের মধ্যে বীর হতেন, পাশাপাশি লাখো নেতাকর্মীদের মাঝে সৃষ্টি হতো উদ্দীপনা। কিন্তু যারাই আটক হয়েছেন তাদের সিংহভাগই পলাতক থাকা অবস্থায়ই হয়েছেন। আন্দোলনে রাজপথে থেকে গ্রেপ্তার হওয়া নেতাদের সংখ্যা অতি নগণ্য। আত্মগোপনে থাকা নেতাদের বিরুদ্ধেও অভিযোগ, তারা কোনো নেতাকর্মীর সঙ্গে যোগাযোগ রাখেননি, দেননি কোনো দিকনির্দেশনাও। এমনকি নিজ মোবাইল ফোনটি পর্যন্ত বন্ধ রেখেছেন। এমন অভিযোগ অসংখ্য নেতাকর্মীর। অবশ্য এরমধ্যে কয়েকজন নেতা আছেন যারা নিজেরা আত্মগোপনে থাকলেও নিজস্ব কর্মীবাহিনীকে আন্দোলনের মাঠে সরব রেখেছিলেন। সাবেক ছাত্রদল নেতা এবং বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির এক সদস্য বলেন, আমাদের নেতারা কতটুকু চতুর হলে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানকে বুঝিয়েছেন আমাদের আন্দোলনের কারণে ভোটাররা ভোট দিতে যাননি। এবার কেন? ২০১৪ এবং ১৮ সালেও তো ছিল না ভোটার উপস্থিতি। তিনি বলেন, সবচেয়ে দুঃখজনক বিষয় হলো, যে সকল নেতা তারেক রহমান সাহেবের সঙ্গে আন্দোলন কর্মসূচির রোডম্যাপ প্রস্তুতে ভূমিকা নিয়েছেন, সেসব নিজেরাই মাঠে সক্রিয় ছিলেন না। এমনকি সেসব নেতার এলাকায়ও কোনো আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেননি অথবা করেননি এবং স্থানীয় নেতাদের নির্দেশনাও দেননি।বিএনপির নয়াপল্টন সূত্র জানায়, আন্দোলন সংগ্রামে গ্রেপ্তারের অজুহাতে গা বাঁচিয়ে চলা নেতাদের তালিকা করছে দলটি। দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সরাসরি তত্ত্বাবধানে সাংগঠনিক ও সহ-সাংগঠনিক সম্পাদকরা নিষ্ক্রিয় নেতাদের তালিকা তৈরি করতে মাঠ জরিপে নেমেছেন। এ কাজে দায়িত্বপ্রাপ্তরা জানিয়েছেন, একদফা আন্দোলনে কে রাজপথে ছিলেন, আর কে সুযোগ বুঝে আত্মগোপনে চলে গিয়েছিলেন, তাদের বিষয়ে খোঁজ চান শীর্ষ নেতৃত্ব। আন্দোলন-সংগ্রামে পরীক্ষিত, যোগ্য ও ত্যাগী নেতাদের নিয়ে কেন্দ্রীয় কমিটি ঢেলে সাজাতেই এই উদ্যেগ নেওয়া হয়েছে বলে দাবি করেন তারা। সূত্র জানায়, সাংগঠনিক কাজে দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের সম্পৃক্ততার বিষয়টির মনিটর করছে বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব। সাংগঠনিক সম্পাদকদের পাশাপাশি একটি গোপন টিম নিবিড় পর্যবেক্ষণ করছে; সরকারের ‘প্রাইস পোস্টিং’ বা সুবিধাভোগীদের। এ মনিটরিং টিমের একজন বলেন, আন্দোলন চলাকালে দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা কে কোথায় ছিলেন, কে কতটা গুরুত্ব দিয়ে আন্দোলন জিইয়ে রেখেছেন, কে দলের সংকটময় মুহূর্তে মাঠ ছেড়ে পালিয়েছিলেন; সবার আমলনামা লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। এ-সংক্রান্ত কাজের পুরো প্রতিবেদন তারেক রহমানের কাছে হস্তান্তর করার প্রক্রিয়াও শুরু হয়েছে। জানতে চাইলে নারায়ণগঞ্জের বিষয়ে দায়িত্ব পাওয়া বিএনপি স্থায়ী কমিটির একজন বলেন, একতরফা নির্বাচন করে সরকার ফের ক্ষমতার মসনদে বসেছে। আন্দোলনের মাধ্যমেই এ সরকারের পতন ঘটাতে হবে। এবার জোরদার আন্দোলনের নতুন পরিকল্পনা করতে হবে। এর আগে দলকে ঢেলে সাজানোর বিকল্প নেই। এসব নিয়ে দলীয় ফোরামে আলোচনা চলছে। এ কারণে দলের কঠিন সময়ে আন্দোলন সংগ্রামে যারা জান বাজি রেখে রাজপথে ছিল তাদের মূল্যায়ন করতেই মাঠ জরিপের মাধ্যমে সঠিক তথ্য তুলে আনা হচ্ছে। ফলে সত্যিকারের ত্যাগীরাই আগামীতে দলের গূরত্বপূর্ণ পদে থাকবেন; আন্দোলন সংগ্রাম নতুন করে বেগবান হবে। সূত্র জানায়, গত ২৮ ফেব্রুয়ারি বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়াম্যান তারেক রহমান দলের সাংগঠনিক ও সহ-সাংগঠনিক সম্পাদকদের সঙ্গে রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেন। বৈঠকে একদফা আন্দোলন চলাকালে দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতাদের পারফরমেন্স ও অবস্থান সম্পর্কে জরিপ করে বিস্তারিত তথ্য ১০ দিনের মধ্যে তার কাছে জমা দিতে বলেন। এমনকি সাংগঠনিক ও সহ-সাংগঠনিক সম্পাদকদের আলাদা আলদা করে রিপোর্ট তৈরি করার নির্দেশ দেন। যাতে ভিন্ন রিপোর্টে সঠিক তথ্য বেরিয়ে আসে। এর মধ্যেই কয়েকটি বিভাগের সাংগঠনিক তথ্য ভিত্তিক রিপোর্ট ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের কাছে পাঠিয়েছেন দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা। সূত্রের দাবি ঢাকা মহানগর, নারায়ণগঞ্জ সহ পুরো দেশের নিষ্ক্রিয় ও সক্রিয় নেতাদের তথ্য হাতে পাওয়ার পর তারেক রহমান ধাপে ধাপে দল পুনর্গঠনের কাজ শুরু করবেন। এ বিষয়ে নাম না প্রকাশ করার শর্তে বিএনপির এক সাংগঠনিক সম্পাদক জানান, আন্দোলন-সংগ্রামে পরীক্ষিত, যোগ্য ও ত্যাগী নেতাদের নিয়ে কেন্দ্রীয় কমিটি ঢেলে সাজাতে ছোট পরিসরে হলেও কাউন্সিল করার তাগিদ দিচ্ছেন মাঠ পর্যায়ের নেতাকর্মীরা। এ কারনে বিগত আন্দোলনে দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা কে কতটা সক্রিয় ছিলেন তা পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে। মূলত আন্দোলনে যারা নিষ্ক্রিয় ছিল তাদের খোঁজ করতেই ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান সাংগঠনিক সম্পাদকদের মাঠ জরিপের দায়িত্ব দিয়েছেন। তাছাড়া যারা সত্যিকারে জান বাজি রেখে আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন তাদের মূল্যায়ন করতে দলের পদ-পদবিতে তাদের গুরুত্ব দিয়ে তুলে আনা হবে। মাঠ জরিপে পাওয়া তথ্য মতে, দীর্ঘ ১৭ বছর যারা ক্ষমতার বাইরে থেকেও নানা সংকট মোকাবেলা করেও অনেকে টানা আন্দোলন চলাকালে ঘরবাড়ি ছেড়ে বনে-জঙ্গলে রাত কাটিয়েছে। অপরদিকে, দল ক্ষমতায় না থাকলেও অনেকে দলের কাছ থেকে নানা সুবিধা নিয়েছেন। এসব সুবিধাবাদি নেতারা ঘরোয়া কর্মসূচিতে লম্বা-চওড়া বক্তব্য দিলেও ২৮ অক্টোবরের পরে গর্তে ঢুকে গেছেন। কোনো কর্মসূচিতেই তাদের আর মাঠে দেখা যায়নি। অনেকেই মামলা, হামলা, গ্রেপ্তার এড়িয়ে নিরাপদ থাকতে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে মিল দিয়ে থেকেছেন। কেউবা ব্যবসা বাণিজ্য ধরে রাখতে ও নানা সুবিধা আদায়ে সরকারের সঙ্গে আঁতাত করে চলছেন। এসব নেতাদের বিষয়ে বিস্তারিত সব তথ্য জোগাড় করেছে মাঠ জরিপে দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা। এ বিষয়ে সম্প্রতি আগাম জামিন পাওয়া এবং ২৮ অক্টোবরের পর থেকে আত্মগোপনে থাকা বিএনপির নারায়ণগঞ্জের এক সিনিয়র নেতা বলেন, আমি গ্রেপ্তার হলে আমার অবস্থা ব্যারিস্টার শাহজাহান ওমর এবং মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ ইবরাহিম মতো হত। আমাকেও ভয়ভীতি দেখিয়ে নির্বাচনে অংশ নিতে সরকার বাধ্য করতো। তাই তারেক রহমান সাহেব নিজেই সিনিয়র নেতাদের আত্মগোপনে থাকতে বলেছিলেন। বিএনপির মাঠ পর্যায়ের একাধিক নেতা জানান, তাদের কাছে তথ্য রয়েছে ভোটের ঠিক আগ মুহূর্তেও অনেকেই আন্দোলনে নিষ্ক্রিয় ছিলেন। হরতাল অবরোধ সফল করতে কেন্দ্রীয়ভাবে বারবার তাগাদা দিলেও অনেক নেতাই তাতে সাড়া দেননি। পাড়া-মহল্লায় পর্যন্ত আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেননি এমন অসংখ্য নেতা রয়েছে দলের বিভিন্ন পর্যায়ে। পদে থাকা ও পদে না থাকা দুই ধরনের নেতারা রয়েছেন এর মধ্যে। দলের কর্মকা- নিয়ে ভেতরের একটি অংশ সমালোচনা করার চেষ্টা করছেন তাদেরও চিহ্নিত করা হচ্ছে। সূত্র জানায়, দীর্ঘদিন সাংগঠনিক কর্মকা- না থাকায় বিএনপির জেলা-উপজেলার সবগুলো ইউনিটে দীর্ঘদিন কমিটি পুনর্গঠন হচ্ছে না। নতুন করে আন্দোলনে নামার আগে এসব কমিটিগুলো দ্রুত পুনর্গঠন করা হবে। নিষ্ক্রিয়দের বাদ দিয়ে মাঠ জরিপে উঠে আসা যোগ্য ও ত্যাগীদের নতুন কমিটিতে শীর্ষ নেতৃত্বে আনা হবে। যাতে দল নতুনভাবে ঘুরে দাঁড়াতে পারে। শুধু মূল দল নয়, দলের অঙ্গসংগঠনগুলোও পুনর্গঠন করা হবে। আর এখনই যেসব সংগঠন পুনর্গঠন করা যাচ্ছে না সেসব স্থানে বিষয়ভিত্তিক কমিটি গঠন করে শূন্যস্থান পূরণ করা হবে। জানতে চাইলে বিএনপির একজন যুগ্ম মহাসচিব বলেন, বিএনপি রাজপথে আন্দোলনের কারণে রক্ত সঞ্চালন অব্যাহত রাখতে পারেনি। নিয়মিত পরিবর্তন এবং পুনর্গঠনের মাধ্যমে দল আরও শক্তিশালী হয়। বিএনপি এবার সংগঠনকে গতিশীল করতে পদক্ষেপ নেবে। এর আগে বিগত আন্দোলনে নিষ্ক্রিয় ও সুবিধাবাদীদের চিহ্নিত করা সবচেয়ে জরুরি। দল এখন সেই কাজটিই করছে। নারায়ণগঞ্জ জেলা বিএনপির এক নেতা বলেন, কমিটি পুনর্গঠন করা উচিত। যারা ব্যর্থ তাদের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দিয়ে যোগ্যদের সুযোগ দেয়া উচিত। বড় আন্দোলনে যাওয়ার আগে নতুন কমিটি গঠন ও শূন্য নেতৃত্ব পূরণের বিকল্প নেই। তিনি বলেন, আন্দোলনের তিন মাসে একটি বড় পরীক্ষা হয়ে গেল। এতে যারা ফেল করেছে; তাদের বাদ দেওয়া উচিত। আর যারা পাস করেছে তাদের পুরস্কার হিসেবে নেতৃত্বে জায়গা দেয়া উচিত। বড় একটি আন্দোলনের পর শীর্ষ নেতারা নিশ্চয়ই বিষয়টি নিয়ে ভাবছেন। তিনি বলেন, সংগঠন পুনর্গঠন নিয়ে তাগিদ অনুভব করছি। বড় কর্মসূচিতে যাওয়ার আগে এটি অবশ্যই দরকার। হরতাল-অবরোধে ঝুঁকি নিয়ে অনেকে মিছিল করেছে; আর অনেকে পদ নিয়ে ঘরে বসে ফেসবুক দেখেছে। অনেক সভাপতি সাধারণ সম্পাদককে খুঁজেই পাওয়া যায়নি।