না’গঞ্জে পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে দেশের প্রথম প্রতিরোধ যুদ্ধে নিহত ৩৩ শহীদের স্বীকৃতি আজো মিলেনি
ডান্ডিবার্তা রিপোর্ট পাক হানাদার বাহিনীকে প্রতিরোধ করতে গিয়ে নারায়ণগঞ্জের মাসদাইরে ৩৩জন বাঙ্গালী নির্মম ভাবে নিহত হওয়ার ৫৩ বছরেও সেই প্রতিরোধ যুদ্ধে শহীদদের স্বীকৃতি মিলেনি আজো। বাংলাদেশ স্বাধীনতা ঘোষনার পর নারায়ণগঞ্জের দামাল ছেলেরা ফতুল্লার মাসদাইরে পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রথম বেসরকারি ভাবে প্রতিরোধ গড়ে তুললে পাক হানাদার বাহিনী ৭১ সালের ২৭ মার্চ মাসদাইরে বিভিন্ন বাড়িঘর মসজিদে হামলা চালিয়ে ৩৩জনকে হত্যা করে। স্বাধীনতার ৫৩ বছর পরও নিহত এইসব শহীদরা এখনো সরকারি ভাবে কোন স্বীকৃতি পায়নি। মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রনালয় ও এসব শহীদদের স্বীকৃতি কিংবা প্রতিরোধের সেই ইতিহাস সংরক্ষণ করেনি। নিহতদের পরিবার একটু স্বীকৃতির আশায় বিভিন্ন দ্বারে দ্বারে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সেই প্রতিরোধ যুদ্ধে নিহতদের পরিবারদের বার বার আশ^াস দেয়ার পরও তাদের সরকারি কোন স্বীকৃতি দেয়া হয়নি। অথচ এনিয়ে নিহতদের পরিবাররা প্রশাসন থেকে শুরু করে বিভিন্ন স্থানে ঘরেও সামান্য শহীদের স্বীকৃতি নিহতদের পরিবারদের আজো দেয়া হয়নি। এর আগে নারায়ণগঞ্জ জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স উদ্বোধনকালে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ.ক.ম মোজাম্মেল হক এই প্রতিবেদককে বলেন, বিষয়টি তার জানা নেই। এ ব্যপারে খোঁজ খবর নিয়ে দেশের প্রথম প্রতিরোধ করতে গিয়ে নিহতদের স্বীকৃতি দেয়া হবে। আজো এইসব শহীদদের নিয়ে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ থেকে শুরু করে প্রশাসনের কেহই এ ব্যপারে কোন উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। শুধুমাত্র একটি স্বৃতিফলক নির্মাণের মধ্য দিয়েই এর দায় সারা হয়েছে। অথচ দেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে প্রথম পাক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যে অঞ্চলের সাধারণ মানুষ প্রতিরোধ গড়ে তুলতে গিয়ে নিহত হয়েছিলেন, সেটা হলো নারায়ণগঞ্জ। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পাক বাহিনী বাঙ্গালীর উপর নির্মম হত্যাযজ্ঞ শুরু করে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে চলে গণহত্যা। ঢাকা গণহত্যার শহরে পরিণত হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব পাক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলাসহ আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার পর তৎকালীণ ইপিআর প্রথম পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। এরপর দেশের কোথাও মার্চ মাসে পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে উঠেনি। ২৬মার্চ পাক হানাদার বাহিনী ঢাকার পাশের শহর নারায়ণগঞ্জে প্রবেশের চেষ্টা করে। এর আগেই ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ পুরাতন সড়কের পাগলা থেকে চাষাঢ়া পর্যন্ত পথে পথে ট্রেনের বগি ফেলে ও বড় বড় গাছ কেটে রাস্তায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। পাক বাহিনী ফতুল্লার মাসদাইর পর্যন্ত বিভিন্ন ভাবে ব্যারিকেড সরিয়ে আসতে পারলেও মাসদাইর বর্তমান পুলিশ লাইনের কাছে এসে বাধাপ্রাপ্ত হয়। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ তৎকালীন এমএলএ একেএম সামছুজ্জোহা ও আফজাল হোসেনের তত্বাবধানে পাক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে সম্মুখ যুদ্ধে লিপ্ত হয়। পাক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে এটাই প্রথম সাধারণ মানুষের প্রতিরোধ যুদ্ধ। এখানে পাক বাহিনীকে ২৬ঘন্টার বেশী সময় আটকে রাখা হয়। আর এর ফলে পাক বাহিনী ৩৩জনকে নির্মমভাবে হত্যার পর ২৭মার্চ দুপুরে শহরে প্রবেশ করে। মূলত মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে এটাই ছিল দেশের প্রথম পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ যুদ্ধ। এই প্রতিরোধ যুদ্ধে নিহতরা এখনও শহীদের মর্যাদা পায়নি বলে শহীদ পরিবারের সন্তান মোহাম্মদ হোসেন অভিযোগ করেন। তবে নারায়ণগঞ্জ জেলা মুক্তিযুদ্ধা সংসদের নব নির্মিত ভবন উদ্বোধনকালে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ.ক.ম মোজাম্মেল হক এই প্রতিনিধির সাথে আলাপকালে জানান, শহীদদের প্রাপ্য মর্যাদাসহ তাদের পরিবারদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করা হবে। কিন্তু আজও তারা সেই মর্যাদা পায়নি। এদিকে সম্প্রতি এ সকল শহীদদের মর্যাদা ও নাম তালিকাভ’ক্ত করার জন্য এবং শহীদ পরিবারের স্বীকৃতি দেয়ার জন্য নারায়ণগঞ্জ মাসদাইর শহীদ পরিবার কল্যাণ সমিতির পক্ষ থেকে ৩৩ জন নিহতের স্মৃতিস্তম্ব করার দাবি জানিয়ে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের মেয়রের কাছে স্বারকলিপি প্রদান করেছিল। সেই প্রতিরোধকালীন সময়ে পাক হানাদার বাহিনী যে ৩৩জনকে বিভিন্ন স্থানে হত্যা করে তখন বর্তমানে কেরানীগঞ্জের পানগাওয়ে বসবাসকারী মোহাম্মদ হোসেন এই হত্যাকান্ডের একজন প্রত্যক্ষদর্শী। মোহাম্মদ হোসেন সেদিনের ঘটনা বলতে গিয়ে আবেগ আপ্লুত কন্ঠে বলেন, শহীদ পরিবারের সদস্য হয়েও আমরা কোন সম্মানী তো দুরের কথা আমাদের স্বীকৃতি পর্যন্ত দেয়া হয়নি। তার চাচাসহ পাঁচজনকে হত্যার সময় মোহাম্মদ হোসেন নিজেও গুলিবিদ্ধ হন। পাক বাহিনী মোহাম্মদ হোসেন মারা গেছে ভেবে চলে যায়। ৩দিন অজ্ঞান থাকার পর জ্ঞান ফিরে দেখেন সে লাশের পাশে পড়ে আছে। এরপর কেরাণীগঞ্জ চলে যান। এব্যাপারে মোহাম্মদ হোসেন জানান, পঙ্গু অবস্থায় দূর্বিষহ জীবন যাপন করলেও সেদিন পাক হানাদার বাহিনী কে প্রতিরোধ করার অপরাধে উত্তর মাসদাইরের ব্যবসায়ী আব্দুস সাত্তার, তার গাড়ির চালক নুর ইসলাম, আশরাফুল ইসলাম, পূর্ব মাসদাইরের সাবেক মন্ত্রী মরহুম আব্দুস সাত্তারের পুত্র তৌফিক সাত্তার ও তার বন্ধু জালাল, পশ্চিম মাসদাইরের ভাষা সৈনিক খাজা জহিরুল হকের বোন হাসিনা হক, ভগ্নিপতি জসিমুল হক সহ দারোয়ান ও দুইজন বাড়ীর কাজের লোককে গুলি করে হত্যা করে। শুধু তাই নয় পাক হানাদার বাহিনীর হাত থেকে বাচঁতে গিয়ে একই এলাকার সাচ্চু, জিন্নাহ ও আকবর মসজিদে আশ্রয় নিলে নরপিশাচরা মসজিদে ঢুকে তাদেরকে গুলি করে হত্যা করে। এছাড়া গুলবদন নামের এক মহিলাকে পুড়িয়ে মারে। ব্যাংকার আব্দুস সাত্তার, জনৈক আনিছুল ইসলামের দুই মেয়ে সহ ৩৩ জনকে নির্মমভাবে ২৭ মার্চ হত্যা করা হয় বলে সেদিনের প্রত্যক্ষদর্শী মো: হোসেন কান্নাজড়িত কন্ঠে জানান। বাংলাদেশের ইতিহাসে এরাই দেশের স্বাধীনতার জন্য প্রথম বেসরকারী শহীদ বলা চলে। সেই হত্যাযজ্ঞের প্রত্যক্ষদর্শী মো: হোসেন এখন কেরানীগঞ্জের পানগাওয়ে অবস্থান করছেন। পঙ্গু এই মুক্তিযোদ্ধার মো: হোসেন ক্ষোভের সাথে বলেন, স্বাধীনতার ৪৯ বছরেও মুক্তিযুদ্ধের কোন সুফল ভোগ করিনি। মুক্তিযোদ্ধার সম্মানটুকু অদ্যাবধি পাইনি। সরকারী সুযোগ-সুবিধা তো দুরের কথা কেউ এ পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধের সেই অবদানকে স্বরণ করে আমাদের স্বীকৃতিটুকুও দেয়নি। অথচ আমাদের বাড়িতেই আমার চাচা আব্দুস সাত্তারসহ মাসদাইর এলাকায় ৩৩জনকে হত্যা করে। মোহাম্মদ হোসেন গুলিবিদ্ধ অবস্থায় ৩দিন অজ্ঞান থাকার পর জ্ঞান ফিরে আসলে মাসদাইর থেকে কেরানীগঞ্জে যান। অথচ সেই মোহাম্মদ হোসেন মুক্তিযুদ্ধের সনদটুকু পর্যন্ত পাননি। তবে কয়েক বছর আগে মুক্তিযোদ্ধাদের এক অনুষ্ঠানে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ.ক.ম মোজাম্মেল হক বলেন, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের সাথে নারায়ণগঞ্জের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস যাতে লিপিবদ্ধ হয় তার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। যদিও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী এই প্রতিশ্রুতির পর দুই বছর কেটে গেলেও দেশের প্রথম বেসরকারী প্রতিরোধকারী শহীদদের তালিকা প্রদান করে সরকারি ভাবে তাদের কোন স্বীকৃতি দেয়া হয়নি।